রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৪৪ পূর্বাহ্ন




বেহুদা প্যাঁচাল: বিএনপি’র গণসমাবেশ এবং কিছু কথা

বেহুদা প্যাঁচাল: বিএনপি’র গণসমাবেশ এবং কিছু কথা

শামীমুল হক
  • প্রকাশের সময়: সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০২২ ৭:০০ am
জনবহুল রাজনীতি Bangladesh Nationalist Party BNP ‎বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বিএনপি গণসমাবেশ
file pic

অবশ্য যুগে যুগে এমনটাই হয়েছে। বিরোধীদের সকল আন্দোলনই পণ্ড করার চেষ্টা হয়েছে। বৃটিশ, পাকিস্তান আমলে হয়েছে। এর আগেও হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও হয়েছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে হয়েছে। ’৯৫-’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে খালেদা জিয়ার আমলে হয়েছে। বাধা পেরিয়েই বিরোধীরা আন্দোলন চালিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তারা জয়ীও হয়েছে। ইতিহাস তাই বলে

বিএনপি’র খুলনার গণসমাবেশে দু’দিন গাড়ি বন্ধ রেখে মানে ‘ধর্মঘট’ ডেকে কার লাভ হলো? বিএনপি’র সমাবেশ কি বন্ধ হয়েছে? বরং হয়েছে উল্টোটা।

বিএনপি’র সমাবেশকে সারা দেশে আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে গণসমাবেশ হলে হয়তো এত লোক কখনই হতো না। তাই কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি’র গণসমাবেশ সফল করে দিচ্ছে প্রতিপক্ষই। এ যেন পরিবহন ‘ধর্মঘট’ নয়, সমাবেশ সফলে টনিক হিসেবে কাজ করেছে। প্রশ্ন হলো-গাড়ি ‘ধর্মঘট’ এ সময়েই দিতে হবে কেন? দু’দিন পরে দিলে ক্ষতি কি ছিল? কিংবা সমাবেশের সপ্তাহ দিন আগে দিলেই কী এমন হতো? এর জন্য কি কোনো সমাজ পাল্টে যাবে? তাইতো সাধারণ মানুষ এ কথিত ধর্মঘটকে ভালোভাবে নেয়নি।

তারা বলছেন, বিএনপি যখন সমাবেশ ডাকে তখন পরিবহন মালিক সংগঠন পরিবহন ‘ধর্মঘটের’ ঘোষণা দেয়। আবার বিএনপি যখন হরতাল ডাকে, তখন তারা গাড়ি চালানোর ঘোষণা দেয়। কোনো কোনো পরিবহন মালিক বলেছেন, বিএনপি গাড়ি ভাঙচুর কিংবা আগুন দিতে পারে এ শঙ্কা থেকেই তারা পরিবহন চলাচল বন্ধ রেখেছেন।

এখানে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হরতালের মতো সহিংস কর্মসূচিতে যখন পরিবহন চলাচলের ঘোষণা দেয়া হয় তখন গাড়ি ভাঙচুরের শঙ্কা তাহলে থাকে না? সহিংস কর্মসূচিতে এ শঙ্কা না থাকলে সমাবেশ কর্মসূচিতে এ শঙ্কা তো থাকার কথাই নেই। তাহলে গণসমাবেশে গাড়ি ‘ধর্মঘট’ ডাকার অর্থ হলো সমাবেশ বানচাল করা। সেখানে যেন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে না পারে সে চেষ্টা করা। আর হরতালে গাড়ি চালানোর ঘোষণা দেয়া এবং চালানোর অর্থ হলো হরতাল যেন সফল না হয়। আসলে ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ অজুহাত মাত্র।

একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে এভাবে বাধাগ্রস্ত করার কোনো যুক্তি আছে কি? তারপরও যারা যুক্তি খাড়া করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি, যা হচ্ছে তাকে কোনো যুক্তিতেই সমর্থন করা যায় না। কোনো বিবেকসম্পন্ন লোক একে সমর্থন দিতে পারেন না। বরং এ কর্মকাণ্ড দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। পরিবহন সংগঠনগুলোর এ ঘোষণা পক্ষান্তরে সরকারের ওপর গিয়ে পড়ছে। এতে সরকারের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। বিরোধী দলকে সমাবেশে বাধা দেয়ার দায় তাদের নিতে হচ্ছে। খুলনার সমাবেশে গাড়ি বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন।

তারপরও তাদের পথে পথে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। কেউ কেউ পাশের জেলা থেকে নিজস্ব প্রাইভেটকার কিংবা মাইক্রোবাস দিয়ে সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেককে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার যখন লঞ্চ কিংবা বিভিন্ন নৌযানে মানুষজন আসতে থাকে তখনই লঞ্চ ও নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানেও ধাক্কা খায় জনতা। সবচেয়ে বড় কথা খুলনার সমাবেশের আগে ধর্মঘটের দুই দিন বহু মানুষকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ। অনেক রোগীকে রাজধানীতে আসার বাস না পেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে।

অনেক চাকরিপ্রত্যাশী রাজধানীতে আসতে পারেননি পরীক্ষা দিতে। গাড়ি বন্ধ থাকায় চাকরিপ্রত্যাশীরা তাদের ভাগ্য পরীক্ষাও দিতে পারেনি। এরমধ্যে কারও কারও এ সরকারি চাকরির পরীক্ষাই ছিল জীবনের শেষ পরীক্ষা। তারা আশা করেছিলেন এ পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হবেন। সরকারি চাকরি পাবেন। সংসারের হাল ধরবেন। সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস ধর্মঘট তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। চাকরিতে বয়সসীমা তাদের পেরিয়ে যাচ্ছিল। এরমধ্যে শুক্রবারের পরীক্ষা তারা দিতে না পারার আফসোস বয়ে বেড়াবে সারাটি জীবন।

আচ্ছা এতকিছু করেও কি জনসভায় জনস্রোত ঠেকানো গেছে? এ জনস্রোত নিয়েও আছে আবার বিতণ্ডা। চট্টগ্রামের জনসভা নিয়েও আওয়ামী লীগ নেতারা নানা কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বলেছেন, জব্বারের বলি খেলায়ও এর চেয়ে বেশি লোক হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, চট্টগ্রামের জনসভা সুপার ফ্লপ। অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি’র চট্টগ্রামের জনসভায় কেউ বলছেন ২০ হাজার, কেউ বলছেন ৩০ হাজার লোক হয়েছে। আমি মিথ্যা বলবো না।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, সেখানে লাখের কাছাকাছি লোক হয়েছে। চট্টগ্রামের জনসভায় লোক সমাগম নিয়ে যখন এ অবস্থা তখনই খুলনার জনসভা। আর এই জনসভা ঠেকাতে নানা পন্থা অবলম্বন করেও কী লোক ঠেকানো গেছে। মহাসমাবেশের আগের রাতেই জনসভাস্থল লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে পরিবহন ধর্মঘট, লঞ্চ চলাচল বন্ধ এবং পথে পথে বাধা না দিলে আরও বহুগুণে বেশি মানুষের উপস্থিতি ঘটতো এ মহাসমাবেশে। তাহলে প্রমাণিত হয়েছে বাধা দিয়ে কিংবা পরিবহন ধর্মঘট ডেকে মহাসমাবেশ ভণ্ডুল করা সম্ভব নয়।

এ থেকে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো শিক্ষা নেবে কি? তা বুঝা যাবে বিএনপি’র ভবিষ্যৎ মহাসমাবেশগুলো থেকে। সে পর্যন্ত দেশবাসীকে অপেক্ষা করতেই হবে। আরেকটি কথা বলতেই হয়, গত ক’বছর ধরে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের অনেক নেতা জোর গলায় বলেছেন, বিএনপি তো আন্দোলনই করতে পারছে না। তাদের দাবি পূরণ হবে কি? তাদের সমাবেশগুলোতে কোনো লোক হয় না। তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এসব কথা বলে, বিএনপিকে আন্দোলনে যাওয়ার দিকে উস্কে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ওইসব নেতারাই। আর এখন বলছেন, লোক আর কতো হয়েছে? গত রোববার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বিএনপি’র উদ্দেশ্যে বলেছেন, ২০২৯ সালের পরে আপনাদের ভাবতে হবে- এই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা যায় কিনা। যতদিন আপনাদের দলের নেতা থাকবে দুর্নীতিবাজ তারেক ও খালেদা জিয়া ততদিন এদেশের মানুষ বিএনপিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনবে না।

আপনাদের নিজেদের দলের লোকেরাই আপনাদের চোর-বাটপার বলছে। তাই মানুষ আপনাদের ভোট দিবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন হানিফ। আর বিভিন্ন জনসভায় বিএনপি’র মহাসচিব সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছেন। পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। অন্যথায় এদেশে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করছেন। এ দুজনের বক্তব্যই রাজনৈতিক। কিন্তু দুজনের কথায় এটা স্পষ্ট দেশ এখন দু’ভাগে বিভক্ত।

এ বিভক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে অবশ্যই সমাধান প্রয়োজন। আর সে সমাধান হলো একমাত্র আলোচনা আর আলোচনা। সমাবেশে বাধা দিয়ে, গুলি করে সমাধানে আসা যায় না। ইতিহাসে এ পর্যন্ত সকল আন্দোলন কী এভাবে বাধা দিয়ে, গুলি করে দমানো গেছে? এর উত্তর আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি অন্য কোনো দল জানার কথা নয়। আওয়ামী লীগ মাঠের রাজনৈতিক দল। জনগণের দল।

আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকে রাজপথে আন্দোলন করেই দাবি আদায় করতে হয়েছে। রাজপথে লড়াই করেই তারা জয়ী হয়েছে। রাজপথে রক্ত ঝরিয়েই তারা সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সফলতার মুখ দেখেছে। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার আমলে কেন কোনো বিরোধী দল নির্বিঘ্নে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারবে না? কেন বিনা বাধায় মহাসমাবেশে যেতে পারবে না? কেন মহাসমাবেশে যাওয়ার পথে হামলা হবে? এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। তাদের কথা- বিরোধী দলের কর্মসূচি নির্বিঘ্ন করতে সরকার যেখানে সহায়তা করার কথা সেখানে এমন ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

অবশ্য যুগে যুগে এমনটাই হয়েছে। বিরোধীদের সকল আন্দোলনই পণ্ড করার চেষ্টা হয়েছে। বৃটিশ, পাকিস্তান আমলে হয়েছে। এর আগেও হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও হয়েছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে হয়েছে। ’৯৫-’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে খালেদা জিয়ার আমলে হয়েছে। বাধা পেরিয়েই বিরোধীরা আন্দোলন চালিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তারা জয়ীও হয়েছে। ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এটাই বাস্তবতা।

বর্তমান সময়ে বিএনপি’র জনসভাগুলোতে মানুষের ঢল নামছে। এর অন্যতম কারণ কি? এখানেও সাধারণের কথা- মানুষ আর পারছে না। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। আজ যে পণ্য কিনে এনেছে এক দামে কাল গিয়ে দেখে সেই পণ্য বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামে কোনো পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না।

চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর চিনির দাম বেড়ে গেছে। সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আর প্যাকেট চিনি নাকি বাজার থেকে প্রায় উধাও। মানুষ কাটছাঁট করেও জীবন চালাতে পারছে না। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি। এমনটাই জানিয়েছে সিপিডি। অপরদিকে বিদ্যুতের অতিরিক্ত লোডশেডিং মানুষকে অসহ্য করে তুলেছে। খোদ রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। দিনে রাতে একই অবস্থা। এতে করে ব্যাঘাত ঘটছে মানুষের ঘুমের। ব্যাঘাত ঘটছে অফিস আদালতের কাজে। হাসপাতালে রুগীদের কষ্ট বাড়ছে। অপারেশনে সমস্যা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক নাভিশ্বাস পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি থেকে মানুষ পরিত্রাণ চায়।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD