সিডনিতে পাকিস্তানকে আজ দেখা গেছে একটা উজ্জীবিত মেজাজে, নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচের শুরু থেকে চাপে রেখে পাকিস্তান সেমিফাইনাল জিতে নিয়েছে সাত উইকেটে। রবিবার, ১৩ই নভেম্বর মেলবোর্নে ফাইনাল খেলবে পাকিস্তান।
জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েবসাইট ইএসপিএনক্রিকইনফোতে মার্ক নামের এক ক্রিকেট দর্শক মন্তব্য করেছেন, “পাকিস্তান ছিল তলানিতে এবং টুর্নামেন্টের সমীকরণের বাইরে। সেখান থেকে এখন ফাইনাল নিশ্চিত করা প্রথম দল পাকিস্তান ঠিক যেন ১৯৯২ সালে ফিরে আসছে।”
টিভির পর্দায় সিডনির মাঠে পাকিস্তানের ক্রিকেট এবং গ্যালারিতে সমর্থকদের দেখে এমনটাই মনে হয়েছে। ম্যাচের প্রথম ওভার থেকেই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় খেলার, ফাস্ট বোলার শাহীন শাহ আফ্রিদি প্রথম ওভারেই ফিন অ্যালেনকে আউট করে ম্যাচের মোমেন্টাম পাকিস্তানের পক্ষে নিয়ে আসেন।
হারশা ভোগলে পাকিস্তানের খেলা দেখে বিস্ময়ে টুইট করেছেন, “আপনি যদি পাকিস্তানের কাছে এই ফিরে আসার চিত্রনাট্য চাইতেন, তারা নিজেরাও এটা বলতে পারতো না বলেই আমি মনে করি।”
বাবর আজম ও মোহাম্মদ রিজওয়ান, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনটি শত রানের জুটি গড়েছেন, টুর্নামেন্টের ইতিহাসে এই রেকর্ড আর কোনও জুটির নেই। এই ম্যাচের ঠিক আগেই পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ ম্যাথু হেইডেন বলেছেন, পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম এমন কিছুই করবেন যা বাকিরা দেখে অবাক হবে।
আসলেই তাই, প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র ৩৯ রান করা বাবর, সেমিফাইনালে ব্যাট হাতে নেমে তুলে নিয়েছেন ৪২ বলে ৫৩ রান। তিনি ৩৮ বলেই ৫০ পূর্ণ করেন। এদিন ভাগ্যও ছিল তার পক্ষে। বাবর আজমের ব্যাটের কোণায় লাগা বল প্রথম ওভারেই হাতছাড়া করেন ডেভন কনওয়ে।
পাকিস্তান এবার টপ অর্ডারের ব্যাটিং নিয়ে ভুগছিল, বিশেষত বাবর-রিজওয়ানের ব্যাটে রান না আসায় পাঁচ ম্যাচেই মিডল অর্ডার চাপ নিয়ে ব্যাটিং করেছে। যেখানে পাকিস্তানের টপ অর্ডার রান তুলতেই হিমশিম খাচ্ছিল সেখানে বাবর ও রিজওয়ান আজ সিডনিতে ১০ ওভারে ৮৭ রান তুলে নেন।
পাকিস্তানের জয় ততক্ষণে অনেকটাই নিশ্চিত, টেলিভিশন পর্দায় সম্ভাব্য বিজয়ীর যে প্রেডিকশন দেখাচ্ছিল সেখানে পাকিস্তানের পাশে ৯৪% ছিল ইনিংসের অর্ধেকেই। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার ব্র্যাড হগ টুইটারে লিখেছেন, “বাবরের জাদু যেন আজ কাজে আসতোই।” ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ইরফান পাঠান লিখেছেন, “বাবর ও রিজওয়ান তাদের দলের জন্য সময়মতো পার্টিতে যোগ দিয়েছেন।”
আসলেই এর চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারতো না পাকিস্তানের জন্য। যে দল ভারত ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হেরে এক সপ্তাহ আগেও কোণঠাসা ছিল, সেই পাকিস্তান এখন মেলবোর্নে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে। পাকিস্তানের সমর্থকরাও বলছেন, “এটা অবিশ্বাস্য একটা ঘুরে দাঁড়ানো।”
আজ এজন্য পাকিস্তান নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট দলকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারে, সুপার টুয়েলভ পর্বের শেষ দিন দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে তারা পাকিস্তানের জন্য সেমিফাইনালের দরজা খুলে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকা দ্য এইজের ক্রিকেট সাংবাদিক ড্যানিয়েল ব্রেটিগ টুইট করে লিখেছেন, “হোয়াইটচ্যাপেলের তৈয়বস হোটেলে নেদারল্যান্ডস দলের কোনও ক্রিকেটারের আর বিল দেয়ার চিন্তা করতে হবে না।” যুক্তরাজ্যের ইস্ট লন্ডনের এই পাঞ্জাবি রেস্তোঁরা চালান পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা।
ম্যাচ শেষে মোহাম্মদ রিজওয়ান বলেন, “আমার আর বাবরের পরিকল্পনা ছিল প্রথম বল থেকেই নতুন বল পেটানো। আমরা পাওয়ারপ্লে শেষে ভেবেছি একজনকে শেষ পর্যন্ত খেলতে হবে। ছেলেরা পরিশ্রম করেছে এবং বিশ্বাস ধরে রেখেছে।”
শাহীন শাহ আফ্রিদি এই বিশ্বকাপ দিয়েই দীর্ঘ সময়ের চোট কাটিয়ে মাঠে ফিরেছেন। এখন তিনি বিশ্বকাপের সেরা পারফর্মারদের একজন। আজকের দুটি উইকেটসহ, ৬ ম্যাচে তিনি ১০ উইকেট নিয়েছেন।
রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ছয়ের মতো। আজ প্রথম ওভারেই বাঁ হাতি ফাস্ট বোলার একের পর এক ইন সুইং দিয়ে ফিন অ্যালেনকে পরাস্ত করা শুরু করেন। তৃতীয় বলটি একেবারে খাপে খাপ এলবিডব্লিউ করেন শাহীন শাহ। সেখান থেকেই ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ নেয় পাকিস্তান ক্রিকেট দল।
শাহীন শাহ আফ্রিদি ফিন অ্যালেনের পরে সেট হওয়া ব্যাটসম্যান কেইন উইলিয়ামসনের উইকেট নিয়ে নেন।
চার ওভারে ২৪ রান দিয়ে দুটি উইকেট নিয়েছেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। পাকিস্তানের অন্য পেস বোলাররাও খারাপ করেননি, বিশেষ করে ডেথ ওভারে। শেষ ওভারে নাসিম শাহ কোনও বাউন্ডারি হজম করেননি।
স্লো বাউন্সার, গতির বৈচিত্র্য, রিভার্স সুইংয়ে ইয়র্কার সব ধরনের বল তিনি করেন ওই ওভারটিতে। শেষ ওভারে মাত্র আট রান আসে নিউজিল্যান্ডের। শেষ পাঁচ ওভারে আসে ৪৬।
গোটা ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা মাত্র দুটি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। সব দিক থেকেই নিউজিল্যান্ড এই ম্যাচে মাঠে নামার পর থেকে চাপে ছিল।
সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন শাদাব খান, বৃত্তের ভেতরেই সরাসরি এক থ্রো করে তিনি ডেভন কনওয়েকে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছেন, কনওয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নিউজিল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক ড্যানিয়েল শার্নি লিখেছেন, “নিউজিল্যান্ড নিজেদের পুরনো জায়গা ফিরে পেয়েছে এবার- সেমিফাইনালে পরাজিত দল।”
পাকিস্তানের ক্রিকেটার শোয়েব মালিক লিখেছেন, “শাহীনদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ক্রিকেট সমর্থকেরা ইকবাল দিবসের সেরা পুরস্কার পেয়েছে। পুরো জাতিকে অভিনন্দন এই জয়ের। আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে মাত্র এক জয় দূরে আছি।” পাকিস্তান ১৩ বছর পর কোনও বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলবে।