বাজারে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাজেহাল ভোক্তা। সাত দিনে লবণ-চিনিসহ ১৫ পণ্যের দাম বেড়েছে। কখনও বাড়ছে মাঝারি, কখনও চিকন, আবার কখনও মোটা- এভাবে কৌশলে চড়ছে প্রধান খাদ্যশস্য চালের দাম। গেল এক সপ্তাহে সব ধরনের চাল কেজিতে দুই-এক টাকা করে বেড়েছে। একই সঙ্গে আটা-ময়দার দামও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। দাম বাড়ার তালিকায় আবার উঠে এসেছে মসুর ডাল ও ছোলা। একের পর এক পণ্যের দাম বাড়ার কারণে ক্রেতার ওপর চাপ আরও বাড়ছে। আগুন দরের কারণে কেউ কেউ পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন।
অন্য পণ্যগুলো হলো-ডাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, আদা, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, ছোলা, ধনিয়া, জিরা ও লবঙ্গ। আর এসব পণ্য কিনতে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরানবাজার, নয়াবাজার ও শান্তিনগর কাঁচাবাজার ঘুরে এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকায়ও তা লক্ষ করা গেছে।
টিসিবি বলছে, সাত দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনির দাম ২ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি কেজিপ্রতি লবণের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এছাড়া প্রতি কেজি মসুর ডাল ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। কেজিতে আটার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, ময়দা ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ভোজ্যতেল সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ, আদা সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ, রসুন ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, শুকনা মরিচ ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ, হলুদ ২ দশমিক ১৭ শতাংশ, ছোলা ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, ধনিয়া ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, জিরা ৫ শতাংশ এবং প্রতি কেজি লবঙ্গ ২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন কারণ ও অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত অসহায় হয়ে পড়ছেন। তাই পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধে সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা দরকার।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১১৫-১২০ টাকায, যা সাত দিন আগে ১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট দানার প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকায়, এক সপ্তাহ আগে ১৩০ টাকা ছিল। এছাড়া মাঝারি দানার প্রতি কেজি মসুর ডাল ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ১২০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৬২-৬৩ টাকায়, যা আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্যাকেটজাত আটা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৬৬ টাকায়, যা সাত দিন আগে ছিল ৬৩ টাকা। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত ময়দা ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৭৫ টাকা ছিল। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৭৫ টাকায়, যা আগে ছিল ১৭০ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকায়, যা আগে ১৮০ টাকা ছিল। এছাড়া ১০ টাকা বেড়ে প্রতি লিটার পাম অয়েল সুপার বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকায়।
এছাড়া প্রতি কেজি দেশি আদা ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা সাত দিন আগেও ২৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমদানি করা আদা বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়, যা আগে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা, যা সাত দিন আগে ৯০ টাকা ছিল।
প্রতি কেজি দেশি শুকনা মরিচ বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ২৮০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি কেজি দেশি হলুদ ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা সাত দিন আগে ২৩০-২৪০ টাকা ছিল।
প্রতি কেজি ধনিয়া বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, যা আগে ১৪০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
মালিবাগ, তেজকুনিপাড়া ও কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা পর্যায়েও মোটা চাল কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বেড়েছে। মোটা চালের মধ্যে পাইজামের কেজি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা এবং গুটিস্বর্ণা জাতের চাল ৫০ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি চালের মধ্যে বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়, মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকায়। আর নাজিরশাইলের কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা।
তেজকুনিপাড়ার সুমা জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. শুভ বলেন, পাইকারিবাজারে চালের দাম বস্তায় ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চার-পাঁচ দিন ধরে আটা দিচ্ছে না কোনো কোম্পানি।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি কম হচ্ছে। এ কারণে মিলাররা চালের দাম বাড়াচ্ছে। গত এক সপ্তাহে মিলগেটে চালের বস্তায় (৫০ কেজি) ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। চাহিদা মতো চাল দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের। কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, কৌশলে চালের দাম বাড়াচ্ছেন মিলাররা। কয়েকদিন আগে মোটা চালের দাম বেড়েছিল। এখন মিনিকেটের দাম বেড়েছে। চাহিদা মতো চাল দিতেও কার্পণ্য করছেন মিলাররা।
রাজধানীর কাওরানবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাজারে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই। চাহিদার সবটুকু পাওয়া যাচ্ছে, এরপরও দাম বেশি।
কারণ বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর তৎপরতা নেই। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট কাটছে। আর আমাদের মতো ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে নাভিশ্বাস উঠছে।
এদিকে সরকার অনুমতি দিলেও আমদানিকারকরা চাল আমদানিতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও এলসি খুলতে না পারার কারণে অনেক ব্যবসায়ী চাল আমদানি করছেন না।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টনের। এর মধ্যে এলসি খোলা হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৯২ হাজার টনের। আমদানি করা হয়েছে মাত্র ২ লাখ ১২ হাজার টন। তবে সরকারিসহ মোট আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার টন। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মোট গম আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৩ হাজার টন।
এক-দেড় মাস আগে এক দফা বেড়েছিল আটা-ময়দার দাম। এখন আবারও বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে খুচরা পর্যায়ে খোলা আটা কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। খোলা ও প্যাকেটজাত উভয় ধরনের আটা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি দরে। আর ময়দা বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে।
মালিবাগ বাজারের মায়ের দোয়া স্টোরের বিক্রয়কর্মী আল-আমীন বলেন, আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা করে। খোলা এবং প্যাকেটজাত দুই ধরনের আটাই বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা দরে। এরপরও কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, প্যাকেটজাত আটার দাম আরও বাড়াবে তারা।
ডালের দরও ছুটছে। দেশি মসুর ডাল ১৪০ এবং আমদানি করা মসুর ১০৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহ খানেক দেশি মসুর ১৩৫ এবং আমদানি করা মসুর ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোলার দাম এক সপ্তাহে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৮ থেকে ৯০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে ছোলা বিক্রি হয়েছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়।
প্যাকেটজাত চিনির সংকট এখনও কাটেনি। দু-এক দোকানে খোলা চিনি মিললেও কেজি কিনতে হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পর বাজারে সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে খুচরা পর্যায়ে এখনও দাম বাড়েনি।
ভোগ্যপণ্য আমদানি ও বাজারজাত করে এমন একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা বলেন, ডলার সংকটের কারণে কোম্পানিগুলো এলসি খুলতে পারছে না, গ্যাস সংকটে কারখানায় উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। আমদানি না হলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে কীভাবে?
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাজার তদারকি করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। পণ্যের দাম ভোক্তাসহনীয় করতে কাজ চলমান আছে।