মাঠের এক পাশে তৈরি মঞ্চ। অপেক্ষা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার। কাছেই দাঁড়িয়ে বাবর আজম। ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন তো? পাকিস্তানের জয় তো বহুদূর, ফাইনালই তো হয়নি এখনও! এই দৃশ্যগুলি ফাইনালের আগের দিন দুপুরের। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আসলে মহড়া চলছিল পুরস্কার বিতরণী আয়োজনের। সেখানে দাঁড়িয়ে বাবর কি ফাইনালের পরের ছবিও কল্পনা করছিলেন? নাকি তার চোখে ভাসছিল ৩০ বছর আগের ছবি! এই আঙিনাতেই তো ১৯৯২ বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন ইমরান খান!
বাবরের তখন জন্মও হয়নি। তবে ছবি আর ভিডিও নিশ্চয়ই তিনি অসংখ্যবার দেখেছেন। গত কয়েকদিনে বারবার শুনেছেনও। ইমরানের ওই দলের সঙ্গে এবার বাবরের দলের বিশ্বকাপ অভিযানের এতটা অবিশ্বাস্য মিল যে, চারপাশে কথার জোয়ার, ‘মিরাকল অব নাইন্টি টু’ ফিরছে।
তবে জস বাটলার তা ফিরতে দিতে চাইবেন না নিশ্চিতভাবেই। গ্রাহাম গুচের জায়গায় নিজেকে কল্পনাও করবেন না তিনি। ইংল্যান্ড অধিনায়ক তা বলেও দিলেন সরাসরি, ১৯৯২-কে বদলে দিতে চান তারা।
সেটি ছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টির জন্মেরও প্রায় এক যুগ আগে। তারপরও প্রেক্ষাপট এমন যে, ঘুরেফিরে আসছে ৩০ বছর আগের সেই আসর।
এবারের মতো সেবারও বাজে শুরু করে এক পর্যায়ে খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তান। পরে নিজেরা টানা তিন ম্যাচ জিতে এবং অন্য ম্যাচের সমীকরণ পক্ষে পেয়ে তারা উঠে যায় সেমি-ফাইনালে। সেখানে প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ড। তাদেরকে হারিয়ে ফাইনাল। সেখানে লড়াই ইংল্যান্ডের সঙ্গে। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে।
ফাইনালের লাইন-আপ পর্যন্ত এবারের সঙ্গে হুবুহু মিল। তাই চর্চাও প্রচুর। সেবার ৮৭ হাজার দর্শকের সামনে গুচের ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বজয়ের উল্লাসে মাতে ইমরানের দল। ইতিহাসে তা পরিচিত হয়ে আছে ‘মিরাকল অব নাইন্টি টু’ নামে। এবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে নাকি বদলে যাবে, উত্তর মিলবে রোববার। মেলবোর্নের মহামঞ্চে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের লড়াই শুরু বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায়।
ইমরানের দলের ওপেনার রমিজ রাজা এখন বোর্ডের চেয়ারম্যান। ফাইনালের আগে দলের সঙ্গে দেখা করে সেই সাফল্যের গল্প শুনিয়ে দলকে প্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি। গত কয়েক ম্যাচের দারুণ পারফরম্যান্সে অবশ্য দল এমনিতেও উজ্জীবিত। অধিনায়ক বাবর আজমের কণ্ঠে সেই বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি।
“রোমাঞ্চ আছে। নার্ভাস খুব একটা নই। গত ৩-৪ ম্যাচে দল হিসেবে আমরা ভালো করেছি। সেই বিশ্বাস আমাদের সঙ্গী। ভালো করার বিশ্বাস আছে এবং ফাইনালেও তাই করতে চাই। চাপ তো আছেই। চাপ থাকবেই। তবে চাপ যতটা কাটিয়ে উঠতে পারব, পারফর্ম করার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। দল হিসেবে এবং অধিনায়ক হিসেবে চাওয়া থাকবে শান্ত থাকা এবং বিশ্বাস রাখা। তাতে ফলাফল ভালো হবে আশা করি।”
শান্ত থাকার ব্যাপারটি অবশ্য তাদের মধ্যে বেশ দেখা যাচ্ছে। ফাইনালের আগের দিন অনুশীলন করেনি তারা। বাবরের কথায় ও শরীরী ভাষায় নির্ভার একটা আবহ ফুটে উঠছে। পাকিস্তান ক্রিকেটে ব্যাখ্যাতীত, অভাবনীয় ও অলৌকিক কিছু হয়েছে অনেকবারই। এজন্যই ক্রিকেট বিশ্বে তাদের পরিচিতি অননুমেয় দল হিসেবে। এবারও সেই ভাগ্য তাদের সঙ্গী বলে ধরে নিচ্ছেন অনেকে।
বাবরও সেটিকে এড়িয়ে গেলেন না। বরং এটিই তার কাছে শক্তি-প্রেরণার উৎস।
“আমাদের বিশ্বাসটাই এরকম যে আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি এবং বিশ্বাস করি, যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকেই হচ্ছে। আল্লাহ আমাদের সুযোগ দেন, কাজে লাগানোর দায়িত্ব ও চেষ্টা করার দায়িত্ব আমাদের। আমাদের চেষ্টা থাকবে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার। ফলাফল আল্লাহর হাতে।”
“যে ক্রিকেট আমরা গত কয়েক ম্যাচে খেলেছি, সুযোগ পেয়ে কাজে লাগিয়েছি… আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি অবশ্যই যে আমাদের ফাইনালে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। আশা করি, ফাইনালও আল্লাহই জিতিয়ে দেবেন।”
ইংল্যান্ড আছে ঠিক উল্টো প্রান্তে। ১৯৯২ বিশ্বকাপ ফাইনালের ফল বদলানোর দিক থেকে যেমন, তেমনি এবারের ক্রিকেটীয় দর্শন ও কৌশলেও। তাদের ভরসা প্রক্রিয়া ও পেশাদারীত্বে। গত কয়েক বছরে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যে বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে তারা, আগ্রাসী মানসিকতা ও বিধ্বংসী শরীরী ভাষা দিয়ে যেভাবে পেরিয়ে গেছে একের পর এক বাধা, যেভাবে এসেছে ২০১৯ বিশ্বকাপের সাফল্য ও রঙিন পেশাকে উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা, সেই পথ ধরেই তারা ফাইনাল জিতে পৌঁছতে চায় নতুন উচ্চতায়।
সেমি-ফাইনালে ভারতের মতো দলকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে তারা। কিছুদিন আগে পাকিস্তানে গিয়ে তাদেরকে হারিয়ে এসেছে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। তবে ফাইনাল মানে যে ভিন্ন কিছু, সেই পেশাদার ভাবনাও দলে আছে বলে জানালেন অধিনায়ক জস বাটলার।
“স্বাভাবিকভাবেই দলে রোমাঞ্চের অভাব নেই। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে পারা মানে বিরাট সম্মান। খুবই রোমাঞ্চিত আমরা, দলে দারুণ একটি আবহ বিরাজ করছে।”
“আগের পারফরম্যান্সগুলো আমাদেরকে বিশ্বাস জোগাচ্ছে অবশ্যই। তবে কালকে এসব কিছুই কাজে লাগবে না। নতুন দিন, কঠিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে নতুন খেলা। এটা তো জানা কথা, ট্রফির জন্য লড়াই কখনোই সহজ নয়।”
পাকিস্তানের যেখানে প্রত্যাশার চাপ প্রচুর, ইংল্যান্ডের বাস্তবতা এখানেও ভিন্ন। দেশের মানুষকে ক্রিকেটে আগ্রহী করতেই তো কতকিছু করতে হয় তাদের! ২০১৯ বিশ্বকাপের মতো এই ফাইনালও ‘ফ্রি টু এয়ার’ চ্যানেলে দেখা যাবে। ফুটবলের দেশে ক্রিকেটের আবেদন আরেকটু বাড়ানোর এই সুযোগ বাটলারদের জন্য বড় প্রেরণা।
চোটের কারণে সেমি-ফাইনালে খেলতে না পারা দাভিদ মালান ও মার্ক উডকে নিয়ে এ দিনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি বাটলার। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা হতে পারে তাদের জন্য। বিশেষ করে উডকে পেতে দল মরিয়া থাকবে নিশ্চিতভাবেই। গতির ঝড়ে তার একটি স্পেল কিংবা একটি-দুটি ডেলিভারি ঘুরিয়ে দিতে পারে ম্যাচের মোড়।
ফাইনালের এই উত্তেজনায় অবশ্য জল ঢেলে দিতে পারে প্রকৃতি। এই মাঠে এবারের আসরে আগের ৬ ম্যাচের ৩টিই ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, রোববার সন্ধ্যায় মেলবোর্নে বৃষ্টির শঙ্কা শতকরা ৭০ ভাগ। ফাইনালের জন্য রিজার্ভ ডে অবশ্য আছে। প্রথম দিনে খেলা শেষ হতে না পারলে পরদিন আবার শুরু হবে আগের জায়গা থেকেই।
বৃষ্টি এলে বা আকাশ মেঘলা থাকলে ম্যাচের আগের অনেক সমীকরণও বদলে যাবে। ফাইনালের মতো ম্যাচে আসলে আগের সমীকরণের মূল্য এমনিতেও থাকে না খুব একটা। লড়াইটা এখানে প্রবল স্নায়ুর চাপের। এই চাপ যে দল সামলাতে পারবে ভালোভাবে, মেলবোর্নের মহা মঞ্চে জয়ের হাসিতে উদ্ভাসিত হবে তারাই।