দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন কমে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা যারা করছেন, তাদের খরচের ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি আবারও বলেছেন, রিজার্ভের অর্থ জমিয়ে না রেখে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করেছে সরকার। এই অর্থের মধ্যে ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসা নিয়ে আলোচনার মধ্যে সোমবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের শপথ অনুষ্ঠানে এই প্রসঙ্গ তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “হঠাৎ একটা কথা এসেছে রিজার্ভের টাকা নাকি নাই, চুরি হয়ে গেছে। এই চুরি কীভাবে সম্ভব? রিজার্ভের টাকা খরচ হয়েছে মানুষের কল্যাণে, তাদের প্রয়োজন মেটাতে।”
বিএনপি আমলের সঙ্গে এখনকার রিজার্ভের তুলনা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে রিজার্ভ পেয়েছিল আড়াই বিলিয়ন ডলারের মতো, পাঁচ বছরে সেটাকে বাড়িয়ে ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ রিজার্ভ পেয়েছিল ৫ বিলিয়ন ডলার, যা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “রিজার্ভের টাকা সব সময় খরচ হতে থাকে, এটা রোলিং করে। কিন্তু করোনার সময় আমদানি, রপ্তানি, যোগাযোগ, যাতায়াত সবকিছু এক রকম বন্ধ ছিল বলেই রিজার্ভ এতটা জমা পড়েছিল। কিন্তু করোনা শেষ হয়ে গেলে আমদানি-রপ্তানি এমনকি চাষবাষের জন্য মেশিনারিজ ক্রয়ে টাকা ব্যয় করতে হয়। করোনার ভ্যাকসিন ক্রয় এবং বিনামূল্যে টেস্ট করাসহ আনুসাঙ্গিক খাতেও অর্থ ব্যয় করতে হয়। এভাবেই এ টাকা ব্যবহার হয়েছে মানুষের কল্যাণে।”
এরপর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বড় সঙ্কট নিয়ে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রতিটি পণ্যের দাম সারাবিশ্বে বেড়ে গেছে। চাল, গম, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে এর পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত দামে ক্রয় করতে হলেও আমরা তো দেশের মানুষকে কষ্ট দিতে পারি না, যেখানে যত দামই লাগুক আমরা কিন্তু কিনে নিয়ে আসছি, মানুষকে দিচ্ছি।”
টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি মানুষকে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ, ৫০ লাখ মানুষকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“যারা একেবারে অপারগ তাদেরকে বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছি। বিনামূল্যে ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। সাথে সাথে তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করছি।”
রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “৮ বিলিয়ন ডলার আমরা আলাদাভাবে বিনিয়োগ করেছি। আধুনিক বিমান ক্রয় করেছি। এটা আমাদের রিজার্ভের টাকা দিয়েই করেছি, অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার নিইনি। কারণ সেখান থেকে ধার নিলেও সে টাকা সুদসহ শোধ দিতে হত। সেই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিমান নিয়েছে এবং ২ শতাংশ সুদে সেই টাকা আবার ফেরত দিচ্ছে।
“ফলে দেশের টাকা দেশের থাকছে। রপ্তানি ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়ায় টাকা খরচ হচ্ছে, যাতে আমাদের লোকই লাভবান হচ্ছে। কাজেই টাকা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমার দেশের মানুষের জন্য খরচ করতে হবে।”
রিজার্ভের অর্থ বিদেশে পাচারে যে অভিযোগ বিএনপি নেতারা করছেন, সেই ‘অপপ্রচারে’ বিভ্রান্ত না হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “বিএনপির অনেক নেতা মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলেন, তারেক জিয়ার শাস্তি হয়েছে মানি লন্ডারিং কেসে, তার বিরুদ্ধে আমেরিকা থেকে এফবিআইর লোক এসে বাংলাদেশে সাক্ষি দিয়ে গেছে। তাদের নেতাই হচ্ছে খুন, মানিলন্ডারিং ও অবৈধ অস্ত্র চোরাকারবারি মামলার আসামি। আর খালেদা জিয়া এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করে সাজাপ্রাপ্ত।
“বিএনপির গঠনতন্ত্রে সাজাপ্রাপ্তদের নেতা হওয়ার বিধান না থাকলেও সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেই দলটির মূল পদে বসিয়ে রাখা হয়েছে।”
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানে নবনির্বাচিত ৫৯ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৬২৩ জন সদস্যকে শপথ পাঠ করানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম নির্বাচিতদের শপথ বাক্য পাঠ করান। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইবরাহিম অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
নির্বাচিতদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের অনেক দল রয়েছে। কেউ দল থেকে বা কেউ আলাদাভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, যখন আপনি ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তখন আপনার দায়িত্ব সকলের জন্য।”
শেখ হাসিনা নিজের উদাহারণ টেনে বলেন, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে কে তাকে ভোট দিল আর কোন এলাকার ভোটার, সেটা দেখেননি।
“আমি সার্বিকভাবে উন্নয়নের ব্যবস্থা নিয়েছি, প্রতিটি মানুষ যাতে উন্নয়নের ছোঁয়া পায়, সেই ব্যবস্থাই আমরা নিয়েছি।”
৬১টি জেলা পরিষদে ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের আওতায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা এবং এডিপির আওতায় ৫৪০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের তথ্যও জানান তিনি।
বর্তমান সঙ্কটকালে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগী হতে জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের তাদের এলাকাকে খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন, যাতে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদের আওতায় আনা যায়।
সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি নবনির্বাচিত জন প্রতিনিধিদেরকে তাদের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা জনকল্যাণমূলক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই এবং তার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন যেন নিশ্চিত হয় সেটাই আমাদের লক্ষ্য। এখানে আপনাদের একটা বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। এলাকায় কী ধরনের অসুবিধা আছে, মানুষের জন্য কী কল্যাণকর কাজ করা যেতে পারে, উন্নয়নের জন্য কী কাজ করতে পারেন,সেটা আপনাদের ভাবতে হবে। আপনারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েছেন ভোগ দখলের জন্য নয়, জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুসরণের পরামর্শও দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমি আশা করি, আমাদের নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভেতরে ওটাই থাকতে হবে যে মাটি-মানুষ দিয়েই আমরা উন্নতি করতে পারি। কাজেই সেই আদর্শ নিয়েই আপনারা চলবেন।”