একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছাড়া একটি দেশ জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করতে পারে না। একটি দেশের বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় রিজার্ভ থেকে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মুদ্রার বিনিময় হারকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার মাধ্যমে মুদ্রার বিনিময় হার ঠিক রাখে। আবার সংকটকালে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস জোগায় রিজার্ভ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বৈদেশিক মুদ্রার বড় মজুত একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী অবস্থানে রাখে এবং গঠনমূলক অর্থনীতি গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
সাধারণত অর্থনীতিবিদেরা কোনো দেশে তিন মাসের মোট আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকলে সেটাকে নিরাপদ বলে মনে করেন। আবার দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমে থাকাও অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে মনে করা হয়। কারণ, অতিরিক্ত রিজার্ভ অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়া এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি আশানুরূপ না হওয়াকেই ইঙ্গিত করে।
সাধারণত বেশির ভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমা রাখে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো, জাপানের মুদ্রা ইয়েন ও চীনের মুদ্রা ইউয়ানে কিছু মজুত রাখা হয়। বিদেশি মুদ্রার পাশাপাশি ব্যাংক নোট, বন্ড, আমানত, ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য সরকারি সিকিউরিটিজের মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখা হয়। কোনো দেশ নিজ দেশেরই কোনো ব্যাংকে বা বিদেশে অবস্থিত কোনো ব্যাংকেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সংরক্ষণ করতে পারে।
রিজার্ভের শীর্ষে কারা
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে কোন দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সবচেয়ে বেশি এবং কোন দেশগুলো কম রিজার্ভ ও ঋণ নিয়ে ধুঁকছে, তা দেখা যাক। প্রসঙ্গত, একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোনো ফিক্সড বা নির্ধারিত বিষয় নয়, যেকোনো সময় তা পরিবর্তন হতে পারে। সাধারণত বিশ্বের অনেক দেশই রিজার্ভের তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে রক্ষণশীল অবস্থানে থাকে।
২০২২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে শীর্ষ অবস্থানে আছে চীন। দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪৮০ বিলিয়ন বা ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আর হংকংয়ের ৫০৪ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার যোগ করলে তা ৪ ট্রিলিয়ন বা ৪ লাখ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। অবশ্য অক্টোবরের শেষে চীনের রিজার্ভ ছিল ৩০৫২ বিলিয়ন বা ৩ লাখ ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
চীনের রিজার্ভ এত বেশি হওয়ার কারণ কী? চীন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের কমবেশি প্রায় সব দেশে বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে। বেশির ভাগ বৈদেশিক বাণিজ্যই পরিচালনা করা হয় ডলারে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয় করে, যা এই গ্রহের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত।
রিজার্ভে চীনের পরই রয়েছে জাপান (১৩৭৬ বিলিয়ন ডলার) ও সুইজারল্যান্ড (১০৩৩ বিলিয়ন ডলার)। এরপরের সাতটি দেশ হলো রাশিয়া, ভারত, তাইওয়ান, হংকং, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর। এ বছরের জুনে ভারতের রিজার্ভ ছিল ৫৯৯ বিলিয়ন বা ৫৯ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। তবে বছর শেষে এসে তা ৫২০ বিলিয়ন বা ৫২ হাজার কোটি ডলারে নেমে যেতে পারে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ১০ নম্বরে থাকা সিঙ্গাপুরের রিজার্ভ ৩৬৫ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ৮টি এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ। ইউরোপের দেশ আছে দুটি। তালিকায় আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ নেই।
এখানে লক্ষণীয় বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র রিজার্ভের দিক থেকে শীর্ষ দশে নেই। জো বাইডেনের দেশের রিজার্ভ তুলনামূলক কম ২৪২ বিলিয়ন বা ২৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যার বেশির ভাগই রয়েছে ইউরো ও ইয়েনে। আর যুক্তরাজ্যের রিজার্ভ ২১৭ বিলিয়ন বা ২১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
রাশিয়ার রিজার্ভ ৬৩০ বিলিয়ন বা ৬৩ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও অন্যান্য দেশের অবরোধের কারণে ক্রেমলিন তার রিজার্ভ ব্যবহার করতে পারছে না। বিশেষ করে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযানের কারণে অবরোধের শাখা-প্রশাখা আরও বিস্তৃত হয়েছে।
সংকটে থাকা দেশগুলো
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকা, বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ ও সুদ বাড়তে থাকা, একদিকে ডলারের তুলনায় নিজস্ব মুদ্রার মান পড়ে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতির চোখরাঙানি কিছু উন্নয়নশীল দেশকে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে ফেলেছে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অবস্থার কথা আমরা সবাই জানি। পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়াই শুধু দেশটিতে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের কারণ ছিল না। বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্য না পেয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশটির মানুষ। দেশটির রিজার্ভ বলতে কিছুই ছিল না। তাই সংকটকালে জরুরি পণ্য আমদানি করতে পারেনি তারা।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জাম্বিয়া খেলাপি ঋণের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রাশিয়ার বন্ধুদেশ বেলারুশও এই তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, মিশর, এল সালভাদর, ইথিওপিয়া, ঘানা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি দেশটির নাম আর্জেন্টিনা। দেশটির কাছে আইএমএফের পাওনা ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি। এরপরই রয়েছে মিশর, তাদের ঋণের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। আগস্টের শেষে আইএমএফ পাকিস্তানকে দিয়েছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, আগের ঋণ মিলে যা দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২১–এর আগস্টের শেষ সপ্তাহে যা ছিল ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে।
(তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম)