বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন




ভোজ্যতেল চিনি আটা জোগানে দুঃসংবাদ

ভোজ্যতেল চিনি আটা জোগানে দুঃসংবাদ: ভোজ্যতেল চিনি আটা জোগানে দুঃসংবাদ

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২২ ৬:৩০ am
shop food ভোজ্যতেল চিনি আটা mudi dokan bazar মুদি বাজার নিত্য পণ্য দোকান
file pic

নিত্যপণ্যের বাজারে নতুন কোনো শুভবার্তা নেই, আছে দুঃসংবাদ। ভোজ্যতেল আর চিনির দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৯০ টাকা। প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনি ১৩ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা। গরিবের ওএমএসের আটাতেও পড়েছে দামের থাবা। ৬ টাকা বেড়ে এখন এক কেজি আটা কিনতে খেটে খাওয়া মানুষকে গুনতে হবে ২৪ টাকা। এর আগে গত রোববার বাজারের আটার দামও কেজিতে বেড়েছিল ৬ থেকে ৭ টাকা। ফলে নিত্যপণ্যের দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ আরও দুর্বিপাকে পড়ল।

এদিকে কয়েক দফা দাম বাড়ানোর পরও বাজারে ভোজ্যতেল, চিনি ও আটার সংকট এখনও কাটেনি। কোনো কোম্পানি চিনি দিচ্ছে তো ভোজ্যতেল দিচ্ছে না। কেউ তেল দিলেও আটা সরবরাহ করছে না। এ কারণে বাজারে প্রয়োজনীয় এ তিন পণ্যের কিছুটা টান পড়েছে। তবে পাড়া-মহল্লায় এ সংকট খানিকটা বেশি। আবার কিছু জায়গায় এসব পণ্য পাওয়া গেলেও ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, চিনির সংকট চলছে প্রায় দেড় মাস। এরপর যুক্ত হয়েছে আটার ঘাটতি। এক সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে লুকোচুরি। কোম্পানিগুলোর ডিলাররা চাহিদাপত্র নিয়েও পণ্য দিতে করছেন গড়িমসি। কোনো কোনো ডিলার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করায় দিচ্ছেন না ক্রয় রসিদ। এ কারণে খুচরা পর্যায়েও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকার গতকাল ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এখন কোম্পানিগুলো হয়তো বাজারে এ দুই পণ্যের সরবরাহ বাড়াবে।

আর কোম্পানিগুলো বলছে- রাতারাতি এত গ্যাস গেল কই? এলএনজি আমদানি হচ্ছে না। এ কারণে গ্যাসের সংকট। ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ মাত্র এক বছরে ৩৪ বিলিয়নে নেমেছে। ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতিও ভালো নয়। রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এসবই অর্থনীতিকে ফেলেছে চাপে। অর্থনীতি মূলত বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে বেসরকারি খাত ধুঁকছে ডলার, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে। আমদানি থিতু হওয়ার কারণে উৎপাদন কমেছে। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের বাজারে।

তাঁরা বলছেন, এলসিই মূল সমস্যা। আগে ব্যাংকগুলো এলসি নেওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোর পেছনে ঘুরত, এখন কোম্পানিগুলো ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এলসি খোলার আগে কী পণ্য ও কত দামে আমদানি হবে এবং সেগুলোর স্থানীয় বিক্রয়মূল্য কত হবে- বিস্তারিত জানার পর ব্যাংকগুলো মনে করে আমদানিকারকের অর্থ পরিশোধে সংকটে পড়তে পারে, এ কারণে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এলসি খোলার ব্যাপারে পিছু হটে।

নানামুখী সংকট :সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ব্যাংক সংকটে আছে, মানুষের আমানত খোয়া যেতে পারে, দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে- এমন সব গুজবে সবার মনে আতঙ্ক ভর করেছে। এখন আমদানি করলে যদি অর্থ পরিশোধের সময় ডলারের দাম আরও বেড়ে যায় তখন লোকসান গুনতে হবে। এসব কারণে কমছে আমদানি। আগে যাঁরা ৫০ হাজার টন পণ্য আমদানি করতেন এখন করছেন ৩০ হাজার টন।

এছাড়া গ্যাসের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। দুই মাস ধরে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। গ্যাসের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে কারখানায় পণ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কারখানার খরচও বাড়ছে। একদিকে আমদানি কমছে, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রভাবে বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমেছে। যেহেতু ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি আগেই বেড়েছে আটার দাম। তাই অল্প সময়ের মধ্যে এ তিন খাদ্যপণ্যের সরবরাহ সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছে কয়েকটি ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী কোম্পানি।

জানা গেছে, গত তিন-চার মাসে আটার দাম বেড়েছে পাঁচ দফা। আগস্টের শুরুতে প্যাকেটজাত আটার কেজি ছিল ৫১ থেকে ৫২ টাকা; এরপর ওই মাসের মাঝামাঝিতে হয় ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা। অক্টোবরে এসে দাঁড়ায় ৬২ থেকে ৬৩ টাকা। নভেম্বরের শুরুতে আটার কেজি ছিল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা। পাঁচ দিন আগে দাম আরেক দফা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭১ টাকায়। তবে প্যাকেটজাত আটার চেয়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা কমে মিলছে খোলা আটা।

গত দুই মাসে তিন দফা বাড়িয়ে খোলা চিনির কেজি ৯০ এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৯৫ নির্ধারণ করে সরকার। এরপরও সংকট তৈরি হয় পণ্যটির। এখন সরকার আরেক দফা দাম বাড়িয়ে কেজি ১০৮ টাকা করেছে।

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা গত ১ নভেম্বর সয়াবিন তেলের লিটারে ১৫ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই তেলের সংকট শুরু হয়। কিছু জায়গায় খোলা সয়াবিন মিলছে, তবে লিটারে গুনতে হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা। বোতলজাত তেলের সরবরাহ খুব কম দেখা গেছে। তবে গতকাল তেলের নতুন দাম নির্ধারণ হওয়ায় সরবরাহ আবার বাড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।

কী বলছেন খুচরা বিক্রেতারা :জানতে চাইলে নিউমার্কেটের জনপ্রিয় এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ বলেন, ‘দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চিনি, আটা ও তেলের ঘাটতি চলছে। হয়তো কোম্পানিগুলো দাম বাড়াবে, সেকারণে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। দাম বাড়িয়ে হলেও পণ্য দেওয়া উচিত। কারণ ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে সাধারণত পরিচিত ক্রেতারা আসে। তাদের চাহিদামতো পণ্য দিতে না পারলে ক্রেতা ছুটে যায়। যেখানে পাবে সেখানে চলে যাবে। এতে ব্যবসার ক্ষতি হয়। হাতিরপুল কাঁচাবাজারের জাকির জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে চিনির সংকট। আটা আর তেলের সংকট প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। তবে এখন নন-ব্র্যান্ডের কিছু আটা আসছে।

মহাখালী কাঁচাবাজারের ফারাজি স্টোরের স্বত্বাধিকারী বিকাশ বণিক বলেন, চাহিদা নেওয়ার পর কোনো কোম্পানি দিচ্ছে, আবার কোনো কোম্পানি দিচ্ছে না। এ কারণে কিছুটা ঘাটতি আছে।

কোম্পানির কৌশলের পথে ডিলাররা :কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলোর ডিলাররা এ তিন পণ্যের কোনো ক্রয় রসিদ দিচ্ছেন না। কোনো খুচরা বিক্রেতা পণ্য কেনার পর রসিদ চাইলে ডিলাররা সাফ জানিয়ে দেন, রসিদ দিয়ে পণ্য বিক্রি হবে না। এ তথ্যের সত্যতা জানতে গতকাল কারওয়ান বাজারে কিচেন মার্কেটের নিচতলায় এক মুদি দোকানে হাজির হন এ প্রতিবেদক। ওই দোকানের বিক্রয়কর্মী একই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় পুষ্টি ব্র্যান্ডের ডিলারের কাছে নগদ টাকা দিয়ে ক্রয় রসিদসহ তিন কার্টন তেল চাইলে ডিলার তাঁকে দিতে রাজি হননি। তবে রসিদ না নেওয়ার শর্তে তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে।

কোম্পানিগুলো যা বলছে :বসুন্ধরা মাল্টিফুড অ্যান্ড বেভারেজের বিক্রয় বিভাগের নির্বাহী পরিচালক রেদোয়ানুর রহমান বলেন, মূল সমস্যা আমদানি কমেছে। কারণ, এলসি খোলা যাচ্ছে না। আগে এমনও ঘটনা ঘটেছে, একই ব্যাংকের দুই-তিনটি ব্রাঞ্চের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যেত এলসি নেওয়ার জন্য। এখন সেটি উল্টো।

মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র ব্যবস্থাপক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ কারখানায় নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছেও বিক্রি করতাম। এখন নিজেদের কারখানাই চালাতে পারি না। গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগে বাজারে দৈনিক এক হাজার টন তেল সরবরাহ করতাম। এখন ৫০০ থেকে ৬০০ টনের বেশি সরবরাহ করা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, এখন একটা মন্দা চলছে। এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। শুধু সরকার নয়, বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও দেশের স্বার্থে এ মন্দা মোকাবিলায় এগিয়ে আসা উচিত।

টিকে গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মূলত তিন কারণে আটা-ময়দার সরবরাহ কমছে। প্রথমত, বিশ্ববাজারে গম পাওয়া যাচ্ছে না; দামও বেশি। মাঝে ভারত থেকে কিছু গম আমদানি করা গেলেও এখন সেই পথও বন্ধ। দ্বিতীয়ত, চাহিদামতো এলসি খোলা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, গ্যাস-বিদ্যুতের বড় সংকট। ত্রিমুখী সংকটেই ধুঁকছে উৎপাদন। শুধু ভোগ্যপণ্য নয়, অন্য পণ্য উৎপাদনেও একই সমস্যা রয়েছে।

তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ চট্টগ্রামে কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও ঢাকার কারখানাগুলোতে একেবারেই কম। ফলে গত দুই মাসে ঢাকার কারখানাগুলোতে উৎপাদন নেমে এসেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে গমের দামও বেশি। বর্তমানে প্রতি টন গমের দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ ডলার; যা এক বছর আগে ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার।

আবার বাড়ল তেল-চিনির দাম :বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন গত বুধবার পণ্য দুটির দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। এর আগে দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন সংগঠন দুটির নেতারা।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি হবে, যা এত দিন ছিল ১৭৮ টাকা। এ ছাড়া ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯২৫ টাকা। অর্থাৎ ৫ লিটারের বোতলে বেড়েছে ৪৫ টাকা। এছাড়া খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৭২ টাকা। এত দিন খোলা সয়াবিনের লিটার বিক্রি হয়েছে ১৫৮ টাকায়। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েল বিক্রি হবে ১২১ টাকায়।

অন্যদিকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৮ টাকা। এতদিন ছিল ৯৫ টাকা। নতুন দর অনুযায়ী প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা।

ওএমএসের আটার দামও বাড়ল: এদিকে ওএমএসের খোলা আটা কেজিতে ৬ এবং প্যাকেট আটা কেজিতে সাড়ে ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। গত বুধবার ওএমএস কার্যক্রমে বিক্রি করা খোলা ও প্যাকেট আটার এ দাম পুনর্নির্ধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী রোববার থেকে প্রতি কেজি খোলা আটা ভোক্তা পর্যায়ে ২৪ টাকায় বিক্রি হবে, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮ টাকায়। আর দুই কেজি প্যাকেটের আটা বিক্রি হবে ৫৫ টাকায়, এখন এ দাম ৪৬ টাকা।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD