এ বছর (২০২২) চালের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে প্রায় ২৫ লাখ টন কম হতে পারে। চলতি বছরের শুরুতে হাওরে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর চলতি আমন মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন কমতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। সব মিলে এ বছর গত বছরের তুলনায় হেক্টরপ্রতি ফলন ১৩ দশমিক ১ শতাংশ কমবে, যা ২৫ লাখ টনের মতো।
তবে উৎপাদন কমলেও দেশে চালের সংকট নেই। চাহিদার তুলনায় প্রায় ৩৪ লাখ টন চাল বেশি আছে। এই চাল রয়েছে সরকারি গুদাম, বড় চালকলমালিক ও কৃষক, ফড়িয়া, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে।
এমন অবস্থার পরও চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। বর্তমানে দেশে মোটা চালের কেজি ৪৬ থেকে ৫২ টাকা, মাঝারি ৫৪ থেকে ৫৮, আর সরু ৬২ থেকে ৭২ টাকা।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় প্রায় ২৫ লাখ টন উৎপাদন কম হতে পারে বলে তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশে চালের মূল্যবৃদ্ধির একটি সমীক্ষা: কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ের অবস্থা’ শীর্ষক ওই গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার তথ্য ও ব্রির নিজস্ব জরিপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চালের উৎপাদন কম হলেও দেশে কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। তারপরও আমরা দেখতে পাচ্ছি চালের দাম বাড়ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, মূলত চালকলমালিকদের অতিমুনাফা করার কারণে সরবরাহ বাড়লেও দাম কমছে না। ফলে সরকারের উচিত যেসব বড় চালকলমালিকের বেশি পরিমাণে ধান ও চাল মজুতের ক্ষমতা আছে, তাঁদের ব্যাপারে তদারকি বাড়ানো। কেউ দেশের মজুত আইন ভঙ্গ করলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
গবেষক দলটি বলছে, হাওরে হঠাৎ বন্যায় ছয় থেকে আট লাখ টন বোরো ধান নষ্ট হয়। এর পর আমন মৌসুমে ভরা বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়। ফলে আমনের উৎপাদন কমে যায়, সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়েও আমনের ক্ষতি হয়।
ব্রির গবেষণায় ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে চাল উৎপাদনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০১০ সালে উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টন। ২০১৪ সালে তা বেড়ে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টন হয়। এরপরের দুই বছর আবারও চালের উৎপাদন নিম্নমুখী হতে থাকে। ২০১৭ সালে আবারও বেড়ে ৩ কোটি ৬৭ লাখ টন হয়। এরপর ২০২১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আবারও বেড়ে ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭০ হাজার টন হয়। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে তা কমে ৩ কোটি ৬০ লাখ ৭ হাজার টন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ২৪ লাখ ৭০ হাজার টন উৎপাদন কম হবে।
গবেষণাটিতে আরও বলা হয়েছে, ব্রির বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে ২৮টি জাত হচ্ছে প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু। দেশের ৯২ শতাংশ ধানের জমিতে এসব উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের চাষ হচ্ছে। সাড়ে ৪ শতাংশ জমিতে স্থানীয় জাতের চাষ হয়। এর মধ্যে উফশী জাতের চাষ বাড়ছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। দেশি জাতের চাষ কমছে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে। সামগ্রিকভাবে চালের উৎপাদন ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। চলতি বছর দেশে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে।
গবেষণার তথ্যমতে, ২০২২ সালে আমন মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ পড়ে ২৪ টাকা ৩১ পয়সা, আর তা বিক্রি করে পান ২৮ টাকা ৭৪ পয়সা। বোরোতে ২৬ টাকা ১০ পয়সা খরচ আর দাম পান ৩০ টাকা ৮০ পয়সা।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, এ বছর কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যে কারণে সরকার বাধ্য হয়ে চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম কমানোর চেষ্টা করছে। তবে দেশে কী পরিমাণ চাল আমদানি করতে হবে, তা বোঝার জন্য চালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের উৎপাদনের একটি একক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকা উচিত। আর তা সরকারি একটি সংস্থার মাধ্যমে সমন্বয় করতে হবে।
প্রথম আলো