সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৮ অপরাহ্ন




বৈশ্বিক সংকট : দরকার মুদ্রানীতি ও বাজেটের যথাযথ সমন্বয়

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান
  • প্রকাশের সময়: মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২২ ৭:১৯ pm
ex Atiur Rahman governor bangladesh bank বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান
file pic

করোনাজনিত অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ শুরু করতে না করতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে ধস নামার ফলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা এখন সবারই জানা। বৈশ্বিক এই সংকটের দ্রুত বাঁক বদলের কারণে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটিই এখন বড় ভাবনার বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।

সাধারণত বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রক্ষেপণ আর পূর্বানুমানগুলো সামনে রেখে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল তৈরি করা হয়। কিন্তু তাদের প্রক্ষেপণগুলোয়ও ঘন ঘন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

আইমএফ-এর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক-এর অক্টোবর ২০২২-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি আগে যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি মাত্রায় স্থবির হয়ে পড়ছে। তারা বলছে ২০২২ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ৩.২ শতাংশ। আগের বছর এই হার ছিল ৬ শতাংশ। আর সামনের বছর এবারের চেয়ে আরও কমে হবে ২.৭ শতাংশ।

এক দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোর তালিকায় থাকা বাংলাদেশেও এই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রভাব পড়বে—এটাই স্বাভাবিক। যদিও অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এই সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে, তবুও আগের বছরের তুলনায় এই বছর প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে।

আইএমএফ-এর আউটলুক বলছে ২০২২ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ (আগের বছর ছিল ৭.২ শতাংশ)। বিশ্বব্যাংকের আগে ২০২২-এ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশ হবে প্রক্ষেপণ করলেও এখন বলছে ৬.১ শতাংশ হবে। এডিবি প্রথমে এই বছরের প্রবৃদ্ধি ৭.১ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করে, পরে তা কমিয়ে ৬.৬ শতাংশ বলছে।

আমাদের সরকার ২০২২ সালের জন্য ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তবে বোঝাই যাচ্ছে বাস্তবতার নিরিখে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থা বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সংস্থার দেওয়া প্রক্ষেপণও উচ্চাভিলাষী মনে হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে, আমার মনে হয় যদি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারি সেটিই হবে বড় অর্জন।

আগেই বলেছি যে, আমরা অন্য অধিকাংশ দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ইতিমধ্যেই যে নীতি-সংবেদনশীলতা দেখা যাচ্ছে তাতে করে আশা করা যায় যে এই চলমান সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রেও আমরা অন্য সবার চেয়ে এগিয়েই থাকব।

তবে এই মুহূর্তে চোখ-কান খোলা রেখে বাকিদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোনোর কোনো বিকল্প নেই। এই প্রসঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা সর্বশেষ যে বিপাকে পড়েছিল তার প্রধানতম কারণ তাদের মুদ্রানীতি এবং করনীতি (তথা বাজেট)-এর মধ্যে সমন্বয় না থাকা। ডলারের বিপরীতে পাউন্ড স্টারলিংয়ের দরপতন মোকাবিলায় সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিকে পলিসি রেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল।

অন্যদিকে বাজেটে ধনীদের কর ছাড় দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল। কর ছাড় দিয়ে যেকোনো মূল্যে প্রবৃদ্ধির চাকাকে বেগবান করার এই উদ্যোগগুলোর মার্গারেট থ্যাচার (Margaret Thatcher)-এর আমলের কৌশলের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এগুলো একেবারেই খাটে না। ফলে অবধারিতভাবেই হুমকির মুখে পড়ে গেছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ভারসাম্য।

পরবর্তীতে সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। মনে হচ্ছে ঋষি সুনাকের সরকার আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথেই এগোবে। সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সময়োপযোগী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট আছে। এখনো সেখানে মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি। তবুও পরিস্থিতি কিছুটা আশা জাগানিয়া।

বাংলাদেশের জন্য আশার বিষয় এটাই যে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বিদ্যমান বাস্তবতা ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সদা সচেতন আছেন। সরকারের নির্দেশনা ও সহযোগিতায় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলার বেশকিছু সময়োচিত উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নিয়েছে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবাহ বহাল রাখা এবং সম্ভব হলে এই প্রবাহ বাড়ানোর নানা চেষ্টাও আমাদের আশাবাদী করছে। তবে এখনো কিন্তু ডলার বিনিময় হার বিভিন্ন অংশীজনের জন্য বিভিন্ন রকমই রয়েছে। একে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। সেটি সম্ভব না হলেও অন্তত একটি নির্দিষ্ট সীমা (ব্যান্ড) যদি নির্ধারণ করে দেওয়া যায়, যে সীমার মধ্যে থেকে বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে অংশীজনেরা ডলার বিনিময় করতে পারবেন—তাহলে আমরা সংকট মোকাবিলায় আরও শক্তি দেখাতে পারবো বলে আমার মনে হয়। একই সঙ্গে বাজেটারি উদ্যোগগুলো আরও জোরদার করা চাই।

অল্প আয়ের মানুষেরা (এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন মধ্যবিত্তরাও) নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চাপের মুখে পড়েছেন। কম মূল্যে তাদের কাছে নিত্যপণ্য পৌঁছানোর জন্য কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান, ওএমএস-এর ট্রাক সেল-এর মতো উদ্যোগ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।

এগুলো পরীক্ষিত ও প্রশংসিত কর্মসূচি। বিদ্যমান বাস্তবতায় এগুলোর পরিধি বাড়ানো এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী কর্মসূচি গ্রহণের জন্য বাজেট বরাদ্দ যতটা সম্ভব বাড়ানো দরকার। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে যে বার্তাগুলো আসছে তাতে আসা করতে পারি যে সরকার সেদিকেই এগোবে সামনের দিনগুলোয়।

মুদ্রানীতি এবং করনীতি তথা বাজেটের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে যে বড় অর্থনৈতিক সংকট কার্যকর মোকাবিলা করা যায়—সেই অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে যখন মার্কিন হাউজিং মার্কেটের সৃষ্ট সংকটের ফলে বৈশ্বিক অস্থিরতা চলছিল সেই সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখা মনে করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই সময় সদ্য ক্ষমতায় আসা সরকার দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সাথে নিয়ে এই সংকট শুধু মোকাবিলাই করেছিল তা নয়, পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছিল।

সেই সময় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘রিয়েল ইকোনমি’তে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল এর আগে আর্থিক সেবার বাইরে থাকা কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর জন্য এবং কুটির-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত করা। এতে একদিকে মানুষের আয় বৃদ্ধির ফলে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছিল।

অন্যদিকে বাড়তি আয়ের ফলে সৃষ্ট বাড়তি চাহিদা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিও দিয়েছিল নতুন গতি। এখনো আমাদের প্রবৃদ্ধি মূলত চাহিদা-নির্ভর। প্রধানত রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য ঋণ প্রবাহ বাড়ানো এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য সেই সময় নেওয়া উদ্যোগগুলোও বিশেষ সুফল দিয়েছিল।

সরকার তার বাজেট তথা করনীতিতেও বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিল। পাশাপাশি কৃষিতে চাহিদা মাফিক ভর্তুকি এবং সামাজিক নিরাপত্তায় ধারাবাহিক বরাদ্দ প্রবৃদ্ধি গতিশীল রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র ধরে রাখায় বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।

সরকারের বাজেট আর আর্থিক সেবা খাতের এই সম্পূরক ভূমিকার জোরেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এমন এক শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো গিয়েছিল যার জোরে আমরা করোনাজনিত স্থবিরতা মোকাবিলায় সাফল্য অর্জন করেছি এবং অল্প সময়ের মধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করতে চাচ্ছি।

ব্রিটেনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের কথা তুলে আমাদেরও সতর্ক থাকা জরুরি। আবার ব্রিটেনের বর্তমান আবহের কথা বলে আশার জায়গা তৈরি করতে চাই। ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হয়ে সংকটের জন্য কারও ওপর দায় না চাপিয়ে বরং সব অংশীজনদের একযোগে কাজ করে সংকট উত্তরণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন।

আতঙ্ক ছড়ানোর পথে না হেঁটে তিনি ভরসার জায়গা তৈরি করতে সচেষ্ট আছেন। ঠিক রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন—“টাকার অভাব বড় অভাব নয়, ভরসার অভাবই বড়।” আমাদেরও এই কথাটি মনে রাখতে হবে।

আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত রয়েছে। আমাদের সম্ভাবনাও অনেক। কাজেই আতঙ্কিত হওয়ার বদলে আস্থার বিনির্মাণে নিয়োজিত হওয়াই কাম্য। আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এমন ভরসার বার্তাই আসছে। সেই বার্তাগুলো সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলো বাস্তবে রূপায়নের দায়িত্ব আমাদের সকলের।

ড. আতিউর রহমান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD