শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:১৪ অপরাহ্ন




অতিথি পাখির কলতানে মুখর জাবি

অতিথি পাখির কলতানে মুখর জাবি: অতিথি পাখির কলতানে মুখর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:৪৮ am
Jahangirnagar University ju logo জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জাবি
file pic

হেমন্ত শেষের দিকে। আর কয়েকদিন পরই শীতকাল। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হলেই ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। সকাল না হতেই পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভাঙছে ঘুম। জানালা খুলে তাকালেই চারদিকে কুয়াশার ঘনঘটা। কুয়াশামোড়া এই সকালে অলসতা জেঁকে বসলেও পাখির কিচিরমিচির শব্দে মন থাকে না হলের রুমে। মনে হয় এক পলকে দেখে আসি পাখির মুক্ত বিচরণ।

বলছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কথা। ঢাকার অদূরে অবস্থিত লাল মাটি আর সবুজের চাদরে ঘেরা এই ভূমি। এখানে প্রকৃতি একেক ঋতুতে একেক রূপে সাজে। আর শীতে শাপলার বুকে অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ ও কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস।

প্রতিবছর শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে জাবি ক্যাম্পাসে আনাগোনা শুরু হয় অতিথি পাখির। আর ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে ফোটে লাল শাপলা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। লাল শাপলার চাদরে মোড়া আঁকাবাঁকা লেক আর লেকের পাড় ঘেঁষা সবুজ গাছের ডালে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে অসংখ্য অতিথি পাখি। ভোর হতেই খাবারের সন্ধানে বের হয় পাখিগুলো। সন্ধ্যা নামলেই শেষ হয় সন্ধান। সারাদিন এসব পাখির কলকাকলি আর জলকেলিতে মুখর হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। এবার নভেম্বরের শেষদিক থেকে ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে।

জানা যায়, ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম অতিথি পাখি আসতে শুরু করে। সাধারণত শীতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা জাবির লেকগুলোতে আসে। হিমালয়ের উত্তরের দেশ সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে বছরের এই সময়ে প্রচুর তুষারপাত ঘটে। এসময় জীবন বাঁচাতে খাদ্যের খোঁজে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আসে পাখিগুলো। জাবি ক্যাম্পাস নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, লেকগুলো খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ায় অতিথি পাখিরা এখানে অবস্থান করে।

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন লেক ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬টি লেক রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবন ও ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেক, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার ও মনপুরা সংলগ্ন লেকে এসেছে অতিথি পাখি। ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেকের পশ্চিম পাশে দর্শনার্থীদের ভিড় ও দোকানপাড় থাকায় লেকের পূর্ব পাড়ে আশ্রয় নিয়েছে পাখিগুলো। এর মধ্যে ঝাঁক বেধে আপন মনে সাঁতার কাটছে কিছু পাখি। কিছু শাপলার পাতায় আপন মনে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছু আবার আকাশে উড়ছে। আবার পরক্ষণেই ঝাঁপ দিচ্ছে লেকের জলে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর চারদিক। সবুজ গাছপালা আর দিনভর লেকের জলে পাখিদের ভেসে বেড়ানো ও জলকেলি খেলা চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা হলে পাখিগুলো আশ্রয় নিচ্ছে লেক সংলগ্ন গাছে

প্রায় ২০৬ প্রজাতির অতিথি পাখির দেখা পাওয়া যায় জাবি ক্যাম্পাসে। এর ১২৬ প্রজাতির দেশীয়, বাকি ৮০টি বিদেশি প্রজাতির। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে পাখিরা ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে আসতে শুরু করে। তবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাখি দেখা যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আগত এসব অতিথি পাখিদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। এর মধ্যে পাতিসরালি, পান্তামুখী, মুরগ্যাধি, গার্গেনি, কোম্বডাক, পাতারি, পচার্ড, ছোট জিরিয়া, পাতারী হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও ফ্লাইফেচার প্রধান। এছাড়া কলাই, ছোট নগ, লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল, কাস্তে চাড়া, জলপিপি, মানিকজোড়, খঞ্জনা, লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল, চিতাটুপি, বামুনিয়া হাঁস, নাকতা, ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি নামের হাজার হাজার পাখি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসে এই ক্যাম্পাসে।

২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। তবে সম্প্রতি ক্যাম্পাসের লেকগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় বিগত কয়েকবছর ধরে অতিথি পাখি কম আসছে। তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছ এবছরও।

পাখিপ্রেমীরা দাবি করছেন, পাখির সুরক্ষায় এবছরও নেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তারা বলছেন, দর্শনার্থীদের নির্দেশনায় যে ব্যানার-ফেস্টুনগুলো টানানো হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবন সংলগ্ন পাড় ও ট্রান্সপোর্টের দোকানগুলোর পেছনে প্রতিনিয়ত ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। এতে পাখি তার নিরাপদ বিচরণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের মোটর বাইকের শোডাউন ও হর্নের শব্দে ভীত পাখিরা। এসব বিষয়ে তদারকির জন্য নিয়মিত টহলের ব্যবস্তা করার পরামর্শ দেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আসিফুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাম্পাসে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের বিভিন্ন সাউন্ড, লেকের পাশের রাস্তায় চলাচলকারী রিকশাসহ অন্যান্য যান-বাহনগুলোর অতিরিক্ত শব্দ পাখির মুক্ত বিচরণে বাধা সৃষ্টি করছে। মাত্রই একজন ড্রোন উড়িয়ে পাখির ভিডিও করছিলেন। এতে পাখিরা ভীত হচ্ছে। এসব বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি প্রয়োজন। পাখির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। তাদের বিচরণের নিরাপদ পরিবেশের ব্যবস্থা করতে না পারলে ভবিষ্যতে তাদের আগমন আরও কমবে।’

লেকগুলোতে অতিথি পাখিদের বিচরণ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই নয়, এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদেরও মন কাড়ে। শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে আর ধুলাবালি মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে শীতের এই সময়ে ক্যাম্পাসে ভিড় করছেন শত শত পাখিপ্রেমী। তাদেরই একজন সুমাইয়া আক্তার। এসেছেন উত্তরা থেকে।

তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে পাখি দেখতে জাবি ক্যাম্পাসে আসছি। সবুজ এই ক্যাম্পাসে পাখির বিচরণ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তাই ব্যস্ততা কাটিয়ে সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসি। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর পাখির পরিমাণ কমেছে।’

পাখি বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘এবার পাখি এখন পর্যন্ত কিছুটা কম, তবে বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে পাখি অনেক বেড়েছে। আশা করা যায় শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পাখি পুরোপুরি আসবে। অন্যবার সেপ্টেম্বরের শেষে আসলেও এবার একটু দেরিতে আসছে। যেহেতু পাখি একটু পরে আসা শুরু হয়েছে তাই বেশি পাখি আসতে একটু দেরি হবে। পাখি আগে আসা কিংবা পরে আসাটা মাইগ্রেশন প্যাটার্নের ওপর নির্ভর করে। শুধু ক্যাম্পাসে নয় অন্যান্য জায়গাতেও পাখি পরে এসেছে। লেকগুলো যদি নিরাপদ ও দর্শনার্থীর কোলাহল কম থাকে তাহলে পাখির সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।’




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD