সরকারি সুবিধা পেয়ে দেশে অন্য অনেক খাত এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে রয়েছে চশমাশিল্প। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষ লোকের অভাবে ভালো মানের চশমা তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা কম দামি চশমার দৌরাত্ম্য চলছে। এটিও দেশীয় চশমাশিল্পের বিকাশে বড় অন্তরায়। ফলে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও আমদানিনির্ভর রয়ে গেছে চশমার বাজার।
সাধারণত দেশের বাজারে দুই ধরনের চশমা বিক্রি হয়-রোদচশমা (সানগ্লাস) ও পাওয়ার লেন্স (চক্ষুচিকিৎসকের নির্দেশিত চশমা)। এ ছাড়া দেশে কন্ট্যাক্ট লেন্সের ব্যবহারও বাড়ছে। তবে বিক্রি হওয়া চশমার ৬০-৭০ ভাগই পাওয়ার লেন্স।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এ পর্যন্ত মাত্র গোটা ১৫ চশমার কারখানা গড়ে উঠেছে। তারা কেবল চশমার ফ্রেমই বানায়। লেন্স আমদানি করা হয়। রোদচশমার পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৮৯ কোটি টাকার রোদচশমা, পাওয়ার লেন্স, ফ্রেম ও আনুষঙ্গিক উপকরণ আমদানি হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত চশমা বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ চশমার আনুষ্ঠানিক বাজার প্রায় ১৭০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে দেশে চশমার বাজার প্রায় সাড়ে আট শ কোটি টাকার হবে বলে দাবি তাঁদের। তাঁরা বলছেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা চশমার বাজার পৌনে সাত শ কোটি টাকার মতো। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চশমা ও লেন্সের ওপর আমদানি শুল্ক অনেক বেশি। এ জন্য ৯০ শতাংশ চশমাই আসে অবৈধ উপায়ে, অর্থাৎ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে। এতে বিপুল পরিমাণে শুল্ক হারাচ্ছে দেশ।
বাংলাদেশ চশমা শিল্প ও বণিক সমিতির তথ্য অনুসারে, দেশে চশমা বিক্রির খুচরা দোকান আছে ১০ হাজারের বেশি। আর রাজধানীর পাটুয়াটুলী, মগবাজার, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় রয়েছে পাইকারি বাজার।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে বছরে আনুমানিক ১ কোটি ৬০ লাখ পিস চশমার লেন্স বিক্রি হয়। চশমার ফ্রেম বিক্রি হয় লেন্সের অর্ধেক। খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি গড়ে ২৫০ টাকা ধরলে লেন্স বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকায়। ফ্রেম বিক্রি হয় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার। বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার কন্ট্যাক্ট লেন্স কেনেন গ্রাহকেরা। কন্ট্যাক্ট লেন্স আমদানিকারক কোম্পানি সফট ড্রিমস ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মিলন মিয়া জানান, প্রতিটির দাম গড়ে ১ হাজার ২৫০ টাকা ধরলে বছরে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার কন্ট্যাক্ট লেন্স বিক্রি হয়।
দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ পিস আমদানি করা রোদচশমা বিক্রি হয়। প্রতিটির দাম গড়ে ২৫০ টাকা ধরলে প্রায় ৩৭ কোটি টাকার রোদচশমা বিক্রি হয়। এ ছাড়া চশমার আনুষঙ্গিক উপকরণ বিক্রি হয় প্রায় আট কোটি টাকার।
রেপ্লিকা ও নিম্নমানের পণ্য
চশমার ফ্রেমের গায়ে বৈশ্বিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম থাকলেও অধিকাংশ পণ্যই চীনে তৈরি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। পাটুয়াটুলীর চশমা গ্যালারির ব্যবস্থাপক আক্তার হোসেন বলেন, ‘দেশে আসল ব্র্যান্ডের পণ্য নেই বললেই চলে। অধিকাংশ পণ্যই মাঝারি ও নিম্নমানের। রেপ্লিকা পণ্যের মধ্যেই ভালো–মন্দ মান নির্ধারণ করে আমরা চশমা বিক্রি করি।’
তবে ভালো মানের পণ্যও বিক্রি করে কয়েকটি কোম্পানি। এর একটি হলো ফ্রান্সের এসিলর। প্রতিষ্ঠানটির এদেশীয় ব্যবস্থাপক কাজী মোস্তফা তাহমিন বলেন, ‘দেশে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ লেন্স ও ফ্রেম নিম্নমানের। গ্রাহকেরাও কম দাম পাওয়ায় এসব পণ্য কিনতে চান। তবে আমরা গ্রাহকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।’
দেশীয় কারখানা
দেশে চশমার ফ্রেম তৈরির ১৫টি কোম্পানি আছে। তবে কোম্পানিগুলো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রাহকদের লক্ষ্য করে কম দামি ফ্রেম বানায়। বাজারে বিক্রি হওয়া চশমার ফ্রেমের ৮–১০ শতাংশ এসব দেশীয় কোম্পানির বানানো।
দেশে চশমার ফেম তৈরির কোম্পানি স্কাইলার্ক অপটিকসের মালিক মনজুরুল হক বলেন, ‘চীন থেকে আনা নিম্নমানের চশমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা পেরে উঠছি না। দেশের চশমাশিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে রাসায়নিক আমদানির শুল্ক কমানোর পাশাপাশি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চশমা আনাও বন্ধ করতে হবে।’
আমদানি শুল্ক বেশি
ব্যবসায়ীরা জানান, চশমা আমদানিতে যেখানে ভারতে ১০, নেপালে ৫ থেকে ১৫ ও শ্রীলঙ্কায় ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক রাখা হয়, সেখানে বাংলাদেশে এই হার ৩১ থেকে ৭৪ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলেন, আগে আমদানি শুল্ক কম ছিল। দেশীয় কোম্পানিকে উৎসাহ দিতে ২০০৭ সাল থেকে শুল্ক বাড়ায় সরকার। কিন্তু আমদানিতে শুল্ক বাড়ালেও দেশে ভালো কোনো চশমার কারখানা গড়ে ওঠেনি। এই সুযোগে অবৈধ আমদানি বেড়েছে।