আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আর মাত্র দুই দিন বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কেউ নিজেকে সাধারণ সম্পাদক পদের দাবিদার হিসেবে ঘোষণা দেননি। নিজের অনুসারী–শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে এই পদ পেতে আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন নেতাদের অনেকে। তবে প্রকাশ্যে তাঁরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না, নীরব থাকেন।
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে সাধারণ সম্পাদকের পদ সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। কর্মী-সমর্থকেরাও এই পদে কে আসছেন, তা জানতে বেশি আগ্রহী, এই পদ নিয়ে আলোচনাও বেশি। কিন্তু বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের টানা তিন মেয়াদে এই পদে থেকে ‘হ্যাটট্রিক’ করতে যাচ্ছেন, নাকি নতুন কেউ আসছেন-এই প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত অজানা।
এর কারণ, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহী নেতারা দলীয় প্রধানের ‘সবুজ সংকেতের’ অপেক্ষায় রয়েছেন।
২৪ ডিসেম্বর শনিবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলে সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে হবে) নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। অবশ্য বরাবরই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্বাচন হয় আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে। ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের উদাহরণ খুব কম। এবারও আলোচনার মাধ্যমেই নেতৃত্ব নির্বাচন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বড় ধরনের পরিবর্তন বা চমক হয়তো দেখা যাবে না। তবে একটি সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দলে গতি সঞ্চার হয়। নির্বাচনের আগে এই সম্মেলন দলকে চাঙা করবে। তিনি বলেন, সভাপতি পদে পরিবর্তন হবে না। এ জন্য হয়তো সাধারণ সম্পাদক নিয়ে কিছুটা আগ্রহ বেশি থাকে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এবারের আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন সাদামাটা হবে-এটি আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা প্রথা ভেঙে এবার জাতীয় সম্মেলন দুই দিনের পরিবর্তনে এক দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে আয়োজনে বাহুল্য বা চাকচিক্য কমলেও সম্মেলন নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রহের কমতি নেই।
আওয়ামী লীগের প্রতিটি সম্মেলনই কোনো না কোনো কারণে আলোচিত হয়। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য কোনো সদস্য নতুন কমিটিতে আসতে পারেন, এমন আলোচনা এবারও আছে। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী কিংবা তরুণ নেতাদের সংখ্যা বাড়তে পারে, এমন কথাও বলছেন নেতাদের কেউ কেউ। এ ছাড়া যাঁরা মন্ত্রিসভায় আছেন, তাঁদের বেশির ভাগকে দলীয় পদে না রাখার মতো ঘটনাও এবার দেখা যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নতুন কমিটিতে কারা থাকবেন, কী পরিবর্তন হতে যাচ্ছে-এসব বিষয়ে স্পষ্ট করে কাউকে কিছু জানাননি ফলে জল্পনাকল্পনার ডালপালা বাড়ছে বলে মনে করেন একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা।
সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক পদে কারা
১৯৮২ সাল থেকে চার দশক ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দলের ভেতরে সভাপতি পদে তাঁর বিকল্প নিয়ে কোনো ভাবনা বা আলোচনাই নেই। ফলে মূল আলোচনা সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য পদগুলো নিয়ে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির স্তর তিনটি। প্রথমত সভাপতিমণ্ডলী, দ্বিতীয়ত সম্পাদকমণ্ডলী, তৃতীয়ত নির্বাহী সদস্যরা। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য ৮১। এর মধ্যে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সভাপতিমণ্ডলী ১৯ সদস্যের। সভাপতিমণ্ডলীর জ্যেষ্ঠ চারজন সদস্য মারা গেছেন। তাঁদের শূন্য স্থানে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে আগামী সম্মেলনে দু-একটা সংযোজন-বিয়োজন আসতে পারে।
সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে ঘিরেই মূলত দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সভাপতির পর সাধারণ সম্পাদকই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এরপর দলের নেতাদের আকর্ষণ যুগ্ম সম্পাদকের চারটি এবং আটটি সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ নিয়ে।
টানা দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন ওবায়দুল কাদের। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। এরপর করোনা মহামারিতে ঘরের বাইরে তাঁর তৎপরতা খুব একটা ছিল না। এ জন্য এই পদে পরিবর্তন আসছে বলেই দলের নেতাদের মধ্যে দু–তিন মাস আগেও বেশ আলোচনা ছিল। কিন্তু সম্মেলন সামনে রেখে তিনি গত দুই মাস জেলায় জেলায় দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। এক দিনে একাধিক জেলা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এমন ধারণা জন্মেছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি থেকে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ।
এর বাইরে সাধারণ সম্পাদকের পদের দাবিদার হিসেবে আরও বেশ কয়েকজন নেতার নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্যাহও সাধারণ সম্পাদক হতে আগ্রহী, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। আবদুর রহমানকেও কেউ কেউ এই পদের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থী মনে করছেন।
অন্যদিকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের প্রায় সবাই সাধারণ সম্পাদকের দাবিদার। এর মধ্যে মাহবুব উল আলম হানিফ ২০০৮ সাল থেকে দলের ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে—এই জন্যই দীর্ঘদিন একই পদে রেখে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁর অনুসারী–শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নামও আলোচনায় আছে। তিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীতে যুক্ত হতে পারেন, এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমও সাধারণ সম্পাদক পদের দাবিদার।
আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির চারজন নেতা বলেছেন, দলের একটা অংশ চাইছে ওবায়দুল কাদেরই সাধারণ সম্পাদক পদে থাকুক। তিনি না হলে হাছান মাহমুদকে এই পদে দেখতে চায় তারা। তথ্যমন্ত্রী হিসেবে গণমাধ্যমে নিয়মিত উপস্থিতি এবং বিরোধী দলের সব আন্দোলনকেই নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারায় তিনি সাধারণ সম্পাদক পদের অন্যতম দাবিদার—এমনটা মনে করেন তাঁর অনুসারীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় একাধিকবার বাহাউদ্দিন নাছিমের ওপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। দলের জন্য তাঁর ত্যাগের কথা স্মরণ করেছেন। ফলে তাঁকেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিবেচনা করছেন কেউ কেউ।
এর বাইরে সাংগঠনিক সম্পাদকসহ অন্যান্য পদেরও অনেকে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও সাধারণ সম্পাদক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে তাঁরা যুগ্ম সম্পাদক পদ পেলেই খুশি হবেন বলে মনে করছে দলীয় সূত্রগুলো। আর যুগ্ম সম্পাদকেরা সাধারণ সম্পাদক না হতে পারলে স্বপদে বহাল থাকার জোর চেষ্টা চালাবেন।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্তর্ভুক্তি
প্রতিবার আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের সময় একটা বিষয় আলোচনায় আসে, তা হলো বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ কি কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসছেন? এবারও এই আলোচনা আছে। বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে আসছেন কি না, তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে।
১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকে তৃণমূল থেকে আসা প্রবীণ সদস্যদের কেউ কেউ জয় ও পুতুলের সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চান। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁরা পরিপক্ব। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেবেন। এ বিষয়ে তিনি কোনো জোর করবেন না।
‘শক্তি’ দেখানোর চাপ থাকবে
সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন—দুটি চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। যে কারণে নির্বাচিত কমিটির নেতাদের ওপর দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপও এবার বেশি থাকবে। এই নেতৃত্বকেই বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করতে হবে। বিজয়ী হতে হবে সংসদ নির্বাচনে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনবার জাতীয় সম্মেলন করেছে আওয়ামী লীগ। এবার চতুর্থ সম্মেলন হবে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের পর দলকে বড় কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে বড় জমায়েত হওয়ায় আওয়ামী লীগও ‘শক্তি দেখানোর’ চাপে পড়েছে। তারাও বড় বড় সমাবেশ করছে। আগামী দিনে রাজনৈতিক শক্তি দেখানোর প্রতিযোগিতা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে নতুন কমিটি করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় রাখা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা
আগামী শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে কাউন্সিলর ও প্রতিনিধি হিসেবে সারা দেশ থেকে ২১ হাজার নেতা যোগ দেবেন। সম্মেলনস্থলের বাইরে হাজারো উৎসুক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি তো থাকবেই। সব মিলিয়ে সম্মেলনের জন্য ৫০ হাজার মানুষের দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
জাতীয় সম্মেলনের আগে জেলা, উপজেলাসহ তৃণমূলের সম্মেলন সম্পন্ন করার কথা। করোনা মহামারির কারণে বর্তমান কমিটি প্রথম আড়াই বছর তেমন কোনো সম্মেলন করতে পারেনি। গত ছয় মাসে সম্মেলনে করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৬৮টির সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। বেশির ভাগই হয়েছে গত নভেম্বর ও চলতি মাসে।
আজ বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির বিদায়ী বৈঠক বসছে। এই বৈঠকেও সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে কথা হবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য এবং এবারের সম্মেলনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘সভাপতি পদে আমরা পরিবর্তন চাই না। সেটা হবেও না। ফলে সাধারণ সম্পাদক পদের দিকেই দৃষ্টি বেশি। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সভাপতি সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটিকেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করবেন।’ [প্রথম আলো]