সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৯ অপরাহ্ন




বিদ্যুৎ খাতের অর্জন লোডশেডিংয়ে বিসর্জন

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ৪:২৯ pm
বিদ্যুৎ loadshedding energy crisis electricity power grid বিদ্যুত বিভ্রাট লোডশেডিং মেগাওয়াট
file pic

দেশের বিদ্যুৎ খাতে গত ১৪ বছরে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর সফলতাও দাবি করা হচ্ছে।

২০০৯ সালের তুলনায় বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা এবং উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণ। ২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। ১৩ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮২৬ মেগাওয়াট।

পাওয়ার ডিভিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৩টিতে। তবে, বিদ্যুতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং শতভাগ বিদ্যুতায়নের সফলতা অনেকটাই মলিন করে দিয়েছে ঘোষণা দিয়ে করা লোডশেডিং।

রোস্টারভিত্তিক লোডশেডিং

করোনা-পরবর্তীতে এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্বের ন্যায় দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ডিজেলভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ায় প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হতে থাকে। ফলে গত ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জ্বালানিবিষয়ক এক বৈঠকে এক ঘণ্টা করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

এছাড়া সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ, যানবাহনে জ্বালানির ব্যবহার কমানো, অফিসের সময়সূচি এক থেকে দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনা এবং রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা কঠোর করা হয়। তবে, এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ স্থানে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সময় ধরে লোডশেডিং হয়। ফলে মানুষের ভোগান্তি পৌঁছায় চরমে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোসহ নানা কারণে গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে সরকার। সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোয় জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়ে।

মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। সে কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি/ক্রয়কৃত ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য সমন্বয় করে ভোক্তাপর্যায়ে এই দাম পুনর্নির্ধারণ করা হলো।

ফলে লিটারপ্রতি ডিজেল ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা, কেরোসিন ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪, অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ এবং পেট্রোল ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মূল্যবৃদ্ধির বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫০ শতাংশ, পেট্রোলের দাম ৫১.১৬ শতাংশ এবং অকটেনের দাম বাড়ে ৫১.৬৮ শতাংশ।

এর আগে ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় এই দুই জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। আট মাসের ব্যবধানে আবারও বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। তবে, ওই সময় পেট্রোল আর অকটেনের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। তবে, এই দফায় বাড়ানো হয় সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রিতে (সব পণ্য) ৮০১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ওই সময় বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জ্বালানি তেলের যৌক্তিক মূল্য সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির পরিকল্পনা

দেশে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কম দামে রাশিয়া থেকে তেল আনা যায় কি না—গত আগস্টে এমন একটি প্রস্তাবনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে পারে, তাহলে আমরা নয় কেন? এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তেল আমদানিতে উদ্যোগ নেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কাছে তেল বিক্রির প্রস্তাবনা দেয় রাশিয়া। কিন্তু এতে কয়েকটি বাধা লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজনৈতিক বাধা। ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে রাশিয়া। ফলে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হলে ইউরোপে বাংলাদেশের যে বিশাল রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে, তা হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

আরেকটি বাধা ছিল বিনিময় পদ্ধতি। সুইফট ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ডলারের বদলে রুবলের মাধ্যমে লেনদেন করতে চাইছিল রাশিয়া। রুবলে বিনিময় হলে অত্যন্ত কম মূল্যে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পর্যাপ্ত রুবল না থাকায় তেল আমদানির সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।

এরপরও নিজেদের তেলের নমুনা বাংলাদেশে পাঠায় রাশিয়া। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চলে যায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। তার দুই সপ্তাহ পর পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল অধিক ভারী হওয়ায় তা দেশে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয়।

জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ টাকা কমানো

গত ২৯ আগস্ট আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ মওকুফ করে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। নতুন এই সিদ্ধান্তের পর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১০৯ টাকা, পেট্রোল ১২৫ এবং অকটেনের দাম দাঁড়ায় ১৩০ টাকা।

জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রসঙ্গে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, শুল্ক কমানোয় লিটারে খরচ কমেছে এক টাকা ৯০ পয়সা। এতে পাঁচ টাকা দাম কমানো হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম চড়ায় থাকায় বিপিসিকে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবার সমন্বয় করা হবে।

গ্রিড বিপর্যয়

চলতি বছরে বিদ্যুৎ খাতে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়। গত ৪ অক্টোবর নরসিংদীর ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সঞ্চালন লাইন ট্রিপ করায় ঢাকাসহ দেশের প্রায় অর্ধেক অংশ পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন থাকে। পরে সংশ্লিষ্টদের চেষ্টায় আট ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ ফিরে আসে।

গ্রিডের এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। প্রাথমিক অনুসন্ধানে ৪ অক্টোবরের ব্ল্যাক-আউটের ঘটনায় গ্রিড ট্রিপকে দায়ী করা হয়। পরে চূড়ান্ত অনুসন্ধানে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দুই কর্মকর্তার গাফিলতির প্রমাণ মেলে।

এর আগে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় গ্রিড বিপর্যয় ঘটে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর। সেবার সারাদেশ ১৭ ঘণ্টা ব্ল্যাক-আউট ছিল। ব্ল্যাক-আউটের পর ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে কারিগরি ত্রুটি, দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা এবং নির্দেশ পালনে অবহেলাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল করা, কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ২০ দফা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু আট বছরেও বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি

চলমান সংকটে সব মহলের আপত্তি সত্ত্বেও গত ২৩ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। বিদ্যুতের দাম পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ছয় টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। বৃদ্ধির হার ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। যা চলতি ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।

পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লেও খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে দাম এখনও বাড়েনি। আগামী জানুয়ারিতে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। ফলে ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এর আগে মে মাসে গণশুনানিতে বিদ্যুতের দাম পাইকারিভাবে তিন টাকা ৩৯ পয়সা বাড়িয়ে আট টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব দেয় বিদ্যুতের একক পাইকারি ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।

বিপিডিবির পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩.১৬ টাকায়। প্রথম দফায় সে প্রস্তাব গ্রহণ না করলেও সর্বশেষ নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD