গত ১২ অক্টোবর অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। ইসির ভাষায়, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’ এর ঠিক আড়াই মাস পরে গত মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরিস্থিতি কি ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল?
রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন ভোটের দিন সকালেও গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘পুরো নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ (যুগান্তর, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে’ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বসে সিসি ক্যামেরায় রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোট পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন। পুরো নির্বাচনি এলাকার ২২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮৬টিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে আলাদা সতর্কতা রাখা হয়। সব কেন্দ্রে মোট এক হাজার ৮০৭টি সিসি ক্যামেরা বসিয়ে সরাসরি ঢাকা থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। কমিশন বলছে, কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা, গোলযোগ বা কারিগরি ত্রুটি তাদের চোখে পড়েনি। (বিডিনিউজ, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার দিনভর রংপুর সিটি নির্বাচনের যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে কোথাও সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ভোটকেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়া, একজনের ভোট আরেকজন দেওয়া বা অন্য কোনও অভিযোগ আসেনি। তবে ইভিএম-এর কারণে ভোট গ্রহণে বিলম্বের অভিযোগ আনেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। শুধু তিনি নন, আরও অনেক ভোটার ইভিএম-এর কারণে ভোটে ধীরগতির অভিযোগ আনেন। এদিন ডেইলি স্টারের খবরে বলা হয়, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের সময় আঙুলের ছাপ না মেলার অভিযোগ করেছেন ভোটাররা। সকাল থেকে অন্তত ১২টি কেন্দ্রের ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনি কর্মকর্তা ও ভোটাররা বলছে, ইভিএমে ভোটপ্রদান প্রক্রিয়া বুঝতে ভোটারদের অনেক সময় লাগছে। পাশাপাশি ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় ভোটপ্রদান প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এ ধরনের নানা জটিলতায় প্রায় সব কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে।’
ইভিএমের এই সমস্যা স্বীকার করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ ধীরগতি দুটো কারণে হয়; একটি আঙুলের ছাপ না মিললে, আর একটি ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে। এর ইতিবাচক দিক আছে। এখানে ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়েছে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)।
তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর অভিযোগকে ‘সিনক্রিয়েট’ বলে মন্তব্য করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন। তার দাবি, নির্বাচন নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের গেম খেলার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। তার ভাষ্য, জাতীয় পার্টির প্রার্থী যখন ভোটকক্ষে ঢোকেন, তখন আরেকজন ভোটার গোপন কক্ষে ভোট দিচ্ছিলেন। ওই ভোটার মেয়র পদে ভোট দেন, কাউন্সিলর পদে ভোট দেওয়া বাকি ছিল। স্বাভাবিকভাবেই গোপন কক্ষে থেকে ভোটার বের হলেই মোস্তাফিজার রহমানকে সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু সে সময়টুকুও দেননি। (প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)।
এতদসত্ত্বেও ইভিএম-এ গাইবান্ধায় বুথের ভেতরে ভোটার ছাড়া অন্য লোক ঢুকে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সেরকম ঘটনা রংপুরে ঘটেনি। তাছাড়া ইভিএম নিয়ে এই সামান্য বিতর্ক বাইরে রাখলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, রংপুর সিটি নির্বাচনে পুরো পরিস্থিতি ইসির নিয়ন্ত্রণেই ছিল। যে কারণে একটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণও স্থগিত করার প্রয়োজন হয়নি। দিনভর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। তীব্র শীত উপেক্ষা করে ভোটাররা এসেছেন। তাদের মধ্যে একটা উৎসবের আমেজ ছিল। প্রশ্ন হলো, গাইবান্ধায় পরিস্থিতি কেন ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল এবং রংপুর সিটিতে কেন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলো?
নির্বাচনে বিদায়ী মেয়র জাতীয় পার্টির নেতা মোস্তাফিজার রহমান (মোস্তফা) পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। রংপুর সিটি যেহেতু জাতীয় পার্টির ঘাঁটি এবং যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকার খুব একটা প্রভাব বিস্তার করে না এবং জাতীয় পাার্টির সঙ্গে সরকারের একটা রাজনৈতিক সমঝোতা আছে, ফলে এখানে যে মোস্তাফিজার রহমানই পুনরায় জয়ী হবেন—সেটি মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। অর্থাৎ কেউ চাইলেও এখানে পরিস্থিতি খারাপ করতে পারতেন না। কারণ, পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করলে তিনি হালে পানি পেতেন না।
দেখা যাচ্ছে, এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ভোট প্রাপ্তির দিক দিয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারেননি। তার মানে এখানে সরকার ও সরকারি দল পুরোপুরি নিরপেক্ষ থেকেছে। নির্বাচনে কোনও ধরনের প্রভাব বিস্তার করেনি। অথচ গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনটি প্রশ্নাতীত থাকেনি। কারণ, সেখানে সরকার ও সরকারি দলের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, ওই নির্বাচনে স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ আনে খোদ নির্বাচন কমিশন। তার মানে যেখানে সরকার ও সরকারি দল প্রভাব বিস্তার করে না, সেখানের পরিস্থিতি ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকে। গাইবান্ধার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কারণে। কিন্তু রংপুরে তারা নিরপেক্ষ থেকেছেন। নিরপেক্ষ থেকেছেন বলে পরিস্থিতি ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল—এ কথা বলা অযৌক্তিক নয়। অর্থাৎ একটি নির্বাচন, সেটি হোক জাতীয় সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকার, সেটি কেমন হবে তার অনেকখানি নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের আচরণের ওপর।
রংপুরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার মূল কারণ এখানে ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার ব্যাপারে সিরিয়াস ছিল না। কারণ, জাতীয় পার্টির সঙ্গে তাদের একটা ‘জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্ট’ আছে। সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দল হলেও জাতীয় পার্টি এমন কোনও কাজ করে না যা সরকারকে বিব্রত করে। ফলে রংপুর সিটি কিংবা জাতীয় নির্বাচনেও বেশ কিছু আসনে সরকার ও সরকারি দল পরোক্ষভাবে তাদের সহায়তা করে।
রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমানের বিপুল ভোটের জয়ের আরেকটি কারণ এখানে বিএনপি দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। কিন্তু বিএনপির ভোটার এখানে আছেন। তাদেরও অনেকে নিশ্চয়ই ভোট দিয়েছেন। তারা কাকে ভোট দেবেন? নিশ্চয়ই নৌকায় নয়। ফলে ধারণা করা যায় যে বিএনপির ভোটও জাতীয় পার্টির প্রার্থী পেয়েছেন। বিএনপির কিছু ভোট হয়তো ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীও পেয়েছেন। কারণ, ভোট পাওয়ার দিক দিয়ে তিনি নৌকার প্রার্থীর চেয়েও এগিয়ে।
রংপুরে জাতীয় পার্টির বিজয়ের আরেকটি কারণ বিদায়ী মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মেয়র ও ব্যক্তি হিসেবেও সেখানে জনপ্রিয়। তার বিরুদ্ধে বড় কোনও অভিযোগ নেই। ফলে এখানে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থানের বাইরেও তার এই ব্যক্তি ইমেজের কারণেও অনেক ভোট তিনি পেয়েছেন। বিশেষ করে যাদের কাছে দল ও প্রতীকের চেয়ে ব্যক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচনের একটা বড় পার্থক্য প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন যেমন ‘ভোট টু বানানা ট্রি’—স্থানীয় নির্বাচনে সবসময় এটি সঠিক নয়। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ার পর থেকে প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজের গুরুত্ব কমলেও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। যে কারণে এখনও স্থানীয় নির্বাচনে দল ও প্রতীকের বাইরেও প্রার্থীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচিতি এবং সামাজিক অবস্থান ভোটাররা বিবেচনায় নেন।
সব মিলিয়ে রংপুর সিটিতে জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমানের জয় সুনিশ্চিত ছিল এটা যেমন মুদ্রার একপিঠ, তেমনি এখানের পরিস্থিতি ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল। কারণ, সেখানে সব প্রার্থী পেশাদার আচরণ করেছেন। নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। ভোটকেন্দ্র দখল করেননি। জয়ের জন্য যা খুশি করা যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে যেকোনও মূল্যে জয়ী করার মানসিকতা ছিল না। ছিল না বলেই রংপুরে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য ভোট হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ’ আসনের পরিস্থিতিও এরকম ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এটিই প্রত্যাশা। অবশ্য সেজন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।