এদেশের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে যার অকুতোভয় অংশগ্রহণ, লড়াই শেষে ‘অস্ত্র সমর্পণ’-এর মধ্য দিয়েই তার আত্মপ্রত্যয়ের সমাপ্তি ঘটে না।
মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন এই রকমই একজন, যিনি দেশের মুক্তি সংগ্রাম শেষে দেশ গঠনের সংগ্রামে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে নিয়মিত সোচ্চার থেকে বঞ্চিতের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন।
তার সাথে আমার পরিচয়ের দীর্ঘ ৩২ বছরে জাতীয় কিংবা জনগণের যেকোনো ক্রান্তিকালে অথবা যেকোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি সর্বদা অগ্রজ কিন্তু সহযোদ্ধার আভরণে একজন সংঘটক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
তিনি নিজেকে সৎ আর নির্ভীক মনোবলের উপর ভিত্তি করে এক নুতন ধারার মুক্তির আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন; সেই আন্দোলন ছিল কখনো পরিবেশ রক্ষার, কখনোবা জনমানুষের গণপরিসেবার আর প্রকৃতির উপর অধিকার রক্ষার অথবা দূষণ আর দখলের বিরুদ্ধে কিংবা ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে। তার অবিচল দৃঢ়তায় জনসম্পৃক্ত পথচলার এই অভিযাত্রা ছিল নিরপেক্ষ ও ক্লান্তিহীন।
তারুণ্যের উপর ভরসা না হারিয়ে তরুণদের উদ্দীপ্ত করার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস ছিল তার কর্ম ধারায়। হোক সে বাংলাদেশ স্কাউটস কিংবা গ্রিনভয়েস বা গ্রিনসেভার্স, ‘এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা’ সম্বোধনে তাদেরকে বিশ্বাস আর মননে পরিপুষ্ট করে উদ্দীপ্ত করার প্রয়াসে তার কার্পণ্য ছিল না।
মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন এই রকমই একজন, যিনি দেশের মুক্তি সংগ্রাম শেষে দেশ গঠনের সংগ্রামে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে নিয়মিত সোচ্চার থেকে বঞ্চিতের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন।
তাই তরুণরাও তাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা’র প্রকৃত আদল বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হিসেবে আপন করেছে আর তার পাশে থেকে মাঠ-প্রকৃতি আর নদী রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে নিয়মিত।
জ্ঞান-নির্ভর পরামর্শ প্রদানে আর অংশগ্রহণে নগর মেয়রদের যেমন করে অভিভাবকত্ব দিয়েছেন, তেমনি ‘নগর সরকার’ ব্যবস্থার মাধ্যমে নগর উন্নয়ন ভাবনায় জনপ্রতিনিধিকেন্দ্রিক জনবান্ধবতা নিশ্চিতেও জোরালো দাবি তুলেছেন।
নাগরিক আন্দোলনের সব ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ‘স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার’ উপর আস্থা রেখে জনস্বার্থে মামলা করার মাধ্যমে অধিকার আদায়ের পথে হেঁটেছেন নিরন্তর। সেই সাথে জনগণের সামনে বিষয়গুলো উপস্থাপনের মধ্য দিয়েও জনসচেতনতায় সচেষ্ট থেকেছেন।
পাঁচ বারের সভাপতি হিসেবে যেভাবে স্থাপত্যের পেশাকে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটকে জনকল্যণমুখী পেশাদারি চর্চায় পরিণত করেছেন, তেমনি দায়বদ্ধ পেশাদারিত্বের প্রয়োজনে তাদের ‘শাস্তি’র আবেদনে দ্বিধান্বিত ছিলেন না।
অতি জনঘনত্বের এই দেশে জনবান্ধব আর প্রকৃতি নির্ভর উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে সামগ্রিক ভৌত অবকাঠামোর পরিকল্পিত বাস্তবায়ন নিশ্চিতে তার নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনে সবাইকে যুক্ত করায় সচেষ্ট ছিলেন।
নাগরিক আন্দোলনের সব ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ‘স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার’ উপর আস্থা রেখে জনস্বার্থে মামলা করার মাধ্যমে অধিকার আদায়ের পথে হেঁটেছেন নিরন্তর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর মতো প্লাটফর্মের মাধ্যমে পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনের আর এক অধ্যায়ে নিজেকে যুক্ত করেন।
সেখানেও স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের বিশ্বাসের প্রতি সৎ থেকে দৃঢ় সংকল্পে প্রতিবাদের এক অবিচল কণ্ঠস্বরে পরিণত হন এই সম্মুখযোদ্ধা, অনুপ্রাণিত করেন অসংখ্য তারুণ্যে উদীপ্ত মানুষদের। হুমকি, মামলা, কিংবা রোদ-বৃষ্টি-ঝড় অথবা অসুস্থতা, কিছুই তাকে অবদমিত করতে পারেনি।
মুক্তি’র যুদ্ধকে ক্রমাগত জাগ্রত রেখে তাকে সব বঞ্চনা, অধিকার হরণ কিংবা দখলদারিত্ব ও দূষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরিণত করে, এই মুক্তিযোদ্ধা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার ‘বাতিঘরে’ পরিণত হয়েছিলেন।
তার আত্মার প্রতি শান্তি কামনায় তাই সাধারণ্যে ব্যাকুল আকুতি; আমরাও তাতে সামিল।
ইকবাল হাবিব। স্থপতি ও নগরবিদ।