বেনামি ঋণ ও ঋণ বিতরণে অনিয়ম ঠেকাতে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ১০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নগদ আদায় ছাড়া পুরোনো ঋণ নবায়ন করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া শতভাগ নগদ টাকা জমা ছাড়া কোন ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত রোববার সন্ধ্যায় ব্যাংকটিকে এই নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ব্যাংকটির আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনা নতুন নয়। এর আগেও ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটির একজন শীর্ষ গ্রাহকের চাপে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন গত বুধবার পর্ষদের চাপে পদত্যাগ করেন। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন। এজন্য ব্যাংকটিতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বড় ঋণ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত কৃষি, চলতি মূলধন, এসএমই ও ভোক্তা ঋণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার আওতায় ঋণ বিতরণ ছাড়া অন্য কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। এছাড়া, ঋণপত্র খুলতে হলে গ্রাহকের কাছ থেকে পুরো টাকা আগে জমা নিতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আগে অনুমোদন হওয়া ঋণের অর্থের ১০ কোটি টাকার বেশি বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। আগের ঋণের বকেয়া অর্থ নগদ আদায় ছাড়া ওই ঋণ নবায়ন করা যাবে না। অন্য ব্যাংকের কোনো ঋণ অধিগ্রহণ করা যাবে না বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সর্বশেষ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংককে নিয়মে ফেরাতে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে বেসিক ব্যাংক ও সাবেক ফারমার্স (এখন পদ্মা) ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক দুটি বিপর্যয়ের হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা পায়নি। এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
গত বুধবার ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেহমুদ হোসেন। পরের দিন বৃহস্পতিবার আর ব্যাংকে যাননি তিনি। এমডি পদে তাঁর মেয়াদ ছিল আগামী ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ব্যাংক খাতের কয়েকটি সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছিল যে পদত্যাগপত্রে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ উল্লেখ করলেও মেহমুদ হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের সিকদার হাউসে ডেকে নেওয়া হয়। এরপরই তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ন্যাশনাল ব্যাংকের আগে মেহমুদ হোসেন এনআরবি ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার এমডি ছিলেন। এর আগে ছয় বছরে চারজন এমডিকে মেয়াদ শেষের আগেই ব্যাংকটি থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
মেহমুদ হোসেন পদত্যাগ করায় ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সৈয়দ রইস উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকে নানা অনিয়ম ও এমডির পদত্যাগের ঘটনা নতুন নয়। গত দেড় দশকে ব্যাংকটির বেশির ভাগ এমডিই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। যে কারণে ২০১৪ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সমন্বয়ক দায়িত্ব পালন করলেও ব্যাংকটির অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ব্যাংকটির মালিকানায় রয়েছে সিকদার গ্রুপ। তারাই ব্যাংকটির নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।