রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছয় বছর, অথচ এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাস পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। পর্যাপ্ত সরকারি খাস জমি থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য জমি বরাদ্দ মেলেনি এবং অবকাঠামো নির্মাণ হয়নি। ফলে সাড়ে ৮০০ শিক্ষার্থীকে ক্লাস করতে হচ্ছে অস্থায়ী ভাড়া করা ভবনে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে ২০১৫ সালের ৮ মে (২৫ বৈশাখ ১৪২২) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালে সংসদে দেশের ৪০তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ আইন পাস হয়। ২০১৭-’১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭ এর ১৫ জুন অ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পান। তার কার্যকাল শেষ হয়ে গেছে ২০২১ এর ১৪ জুন।
এখন পাঁচটি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা সাড়ে ৮০০। বাংলা, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও সঙ্গীত। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক শিক্ষক নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রয়োজন ৫০ জন শিক্ষক, আছেন ২৬ জন। শাহজাদপুরের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী ভিত্তিতে ক্লাস চলছে। এ ছাড়াও ভাড়া বাড়িতে চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। এর জন্য প্রতি মাসে গুণতে হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা ভাড়া।
প্রায় ছয় মাস শূন্য থাকার পর ২০২১ এর ৮ ডিসেম্বর ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ আজম। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থায়ী ক্যাম্পাস অতি আবশ্যক। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া মৌজায় ১০০ একর জমি বরাদ্দ দেন। এরপর অপর একটি আদেশে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর আরো ১১ একর জমি বরাদ্দ দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অদ্যাবধি এই জমি বুঝে পায়নি। শাহজাদপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিয়াকত সালমান জমি বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, দাগ নং ১০৪৭, ১০৩৮ ও ২০৪৩ থেকে উক্ত জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বুড়ি পোতাজিয়া মৌজার আরো ২৩৬ একর খাস জমি বরাদ্দ চেয়েছে।
ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক শাহ আজম বলেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যে স্থানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা খুবই সুন্দর। এখানে বিশ্বভারতীর চেয়েও সাজানো গোছানো ক্যাম্পাস নির্মাণ করা সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২৯ চৈত্র মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে রাউতারা গ্রামের গিরীশচন্দ্র ঘোষকে ১৯৯ বিঘা দান করেন অর্থাৎ খারিজ দলিল করে দেন। উল্লেখ্য গিরীশচন্দ্র ঘোষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলকাতার জোড়াসাঁকো বাড়িতে এবং যখন তিনি শাহজাদপুর অবস্থান করতেন তখন ঘি, ছানা, মাখন ও দধি সরবরাহ করতেন। গিরীশচন্দ্রের আবেদনের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ জমি দান করেন। উক্ত জমি এবং তার নিকটবর্তী প্রায় এক হাজার ৪০০ একর জমি এখন খাস সম্পত্তি, যা সরকারি সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে কিছু জমি গোচারণ ভূমি হিসেবে চিহ্নিত। যা মিল্কভিটার সমবায়ী গোখামারিদের জন্য বরাদ্দ।
যেহেতু সব জমি খাস। অতএব জমি অধিগ্রহণের জন্য কোনো টাকা খরচ হবে না সরকারের। এরপরও অজ্ঞাত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হচ্ছে না।
ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর শাহ আজম জানান, গোয়ালা, বড়াল ও সোনাই নদীর মোহনায় উন্মুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে স্থানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছে সেখানে বিশ্বভারতীর মতো ‘পল্লীশ্রী’ গড়ে তোলা সম্ভব। কৃষি অনুষদের জন্য অনেক জমি দরকার, যা এখানে রয়েছে। তিনি তার পরিকল্পনার কথা বলেন, ‘যেহেতু নিম্ন বা নিচু ভূমি এটি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইমারত সমূহ তৈরি করার আগে মাটি দ্বারা ভরাট করে ভূমির উন্নয়ন করতে হবে। ৩ বছরের একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে।
চলতি বছর রবীন্দ্রবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমের পাঁচ বছর শেষ হবে। প্রথম ব্যাচ তাদের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করবে। ক্যাম্পাসবিহীন প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে ছাত্রছাত্রীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে সন্তুষ্ট নন। মাস্টার্স শেষ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেল রবীন্দ্রবিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে সাংস্কৃতিক ও বিশ্বজনীন পরিবেশ আবশ্যক তা তারা পেলেন না। তাদের আশা খুব দ্রুতই সুন্দর একটি ক্যাম্পাস তৈরি হবে।
প্রতিষ্ঠার পর চার বছরে (প্রফেসর বিশ্বনাথ ঘোষ ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীন) রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬ জন কর্মকর্তা ও ১১৮ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারী জানান, রবীন্দ্রবিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে প্রথমে অস্থায়ী (এডহক) ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। পরে পছন্দের প্রার্থীদের জন্য সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর বয়স, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে তাদের স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্বজিৎ ঘোষের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাস চালু না করা, অবৈধ ছাত্র ভর্তি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ ৫৬ টি অভিযোগের তদন্ত চলছে।
শাহজাদপুরবাসীর দাবি, বিশ্বকবির রেখে যাওয়া জমিতেই বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, অথচ দীর্ঘ ছয় বছরেও অবকাঠামো নির্মাণ না করায় তারা ব্যথিত। খুব দ্রুতই নিজস্ব ক্যাম্পাসে চলবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এমন আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন তারা। [নয়া দিগন্ত]