চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এলাকায় ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে একের পর জন্মসনদ বানাচ্ছিলেন হ্যাকাররা। চসিকের ছয় ওয়ার্ডে এভাবে প্রায় ৭৯৬টি জন্মসনদ বানিয়ে নেওয়ার পর, এসব ওয়ার্ডে নতুন জন্মনিবন্ধন ইস্যু বন্ধ রয়েছে। তবে এবার হ্যাকিং নয়, ‘যান্ত্রিক ত্রুটিতে’ চসিকের সব ওয়ার্ডে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে নতুন জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যুর কাজ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরীর বাসিন্দারা। ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ, গুঞ্জন আর আতঙ্ক।
গত শনিবার রাত থেকে নতুন জন্মনিবন্ধন ইস্যু বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডের সচিব ও জন্মনিবন্ধন সহকারী। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বিষয়ে তাদের হাত নেই। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঢাকা থেকে নতুন জন্মনিবন্ধন ইস্যুর কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিছু কারিগরি কাজ চলছে, এতে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে থেকেই চসিকের ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড, ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড, ৩৮ নম্বর মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ড এবং ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন ইস্যু বন্ধ ছিল। কোথাও টানা চার দিন, আবার কোথাও টানা সাত দিন জন্মনিবন্ধন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন ওইসব এলাকার বাসিন্দারা।
পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের বাসিন্দা গৃহিণী রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। স্কুলে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। এখন ওয়ার্ড অফিস থেকে বলা হচ্ছে, যান্ত্রিক মেরামত কাজের জন্য নতুন সনদ ইস্যু বন্ধ।’
চসিকের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘সব ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন সনদ বন্ধ থাকার বিষয়টি আমি অবগত। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সাময়িকভাবে কাজ স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। খুব সম্ভবত মেরামত কাজ চলছে। আশা করি দ্রুতই সেবা চালু হবে।’
চসিকের আইটি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সার্ভারে কিছু ‘আপডেট’ সংযোজনের পর দ্রুত সব ওয়ার্ডে নতুন জন্ম নিবন্ধন চালু হতে পারে। তবে হ্যাকারের কবলে পড়া ছয়টি ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন কবে, নাগাদ চালু হবে তা স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি দায়িত্বশীলরা।
এর আগে ১০ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত হ্যাকারের কবলে পড়ে চসিকের ছয়টি ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ড থেকে ৭৯৬টি জন্মনিবন্ধন ডিজিটাল জালিয়াতি মাধ্যমে বানিয়ে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়।
এ ডিজিটাল জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাদের হাতে একে একে সাতজন আটক হয়। তবে ধরপাকড় চলাকালেই চসিকের ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে নতুন করে ১৩৩টি জন্মনিবন্ধন সনদ ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে বানিয়ে সার্ভারে আপলোড করা হয়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, সনদ জালিয়াতিতে আরও চক্র আছে। এর মধ্যে পুলিশের হাতে আটক চক্রটি ৫ হাজারের বেশি জন্মসনদ তৈরি করেছে।
এদিকে হ্যাকারের কবলে পড়া ছয়টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীদের জন্য নতুন আইডি সংযোজিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। তবে তারা বলছেন, আইটি সংক্রান্ত নানা সংকট, জটিলতা এবং দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা না গেলে নতুন এ সমস্যা সমাধান কঠিন হয়ে পড়বে।
আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুর লাল হাজারী বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র যদি কেউ নকল করে, সেটা সহজেই ধরা যায়। কিন্তু জন্মনিবন্ধন সনদের জালিয়াতি করলে সেটা ধরা কঠিন। আমাদের পরামর্শ থাকবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা যেন একটু আন্তরিক হন।’
২০০১ সালে কাগুজে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া শুরু হয়। ২০১০ সালে ইউনিসেফের সহায়তায় শুরু হয় ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম। ২০১৯ সালে নতুন সফওয়্যারের জন্মনিবন্ধনের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে চসিকসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন। এ সময় থেকেই দ্বৈত আইডির ব্যবহার শুরু হয়। এরপর থেকে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি), হ্যাকিংসহ নানা বিতর্কে ভোগান্তি বাড়তে থাকে জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যুকরণে। তবে এ নিয়ে সাম্প্রতিক বড় ডিজিটাল জালিয়াতির পর সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডগুলোতে নতুন আইডি ও পাসওয়ার্ড তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। [কালবেলা]