রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ১০:০৫ অপরাহ্ন




সাদা চিনি: পারমাণবিক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী!

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ৯:১৮ pm
sugar sugar sweet tasting soluble carbohydrates food monosaccharides glucose fructose galactose চিনি বস্তা সুক্রোজ গ্লুকোজ sugar
file pic

চিনি কি অত্যাবশ্যকীয় খাবার? প্রিয় সুহৃদ! কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে দেখলাম পয়সা খরচ করে চিনি কেনার জন্যে মানুষ লাইন দিয়েছে।

যখন ছবিটি দেখলাম তখন আশ্চর্যই হলাম যে, আসলে আসক্তি মানুষকে কতটা অসহায় করে তোলে। প্রশ্ন জাগল, চিনির জন্য লাইন দিতে হবে কেন? চিনি কি অত্যাবশ্যকীয় খাবার যা না খেতে পারলে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে?

খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম যে, চিনি পুরোটাই আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদন ২৫-৩০ হাজার টন আর আমদানি করা হয় ২১ লাখ টন। চিনির বাজার ৯৯ শতাংশই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

আমদানিকারকরা প্রতি টন চিনির দাম ৪৭০-৪৮০ ডলার ঘোষণা দিচ্ছেন। অতএব প্রতি টন ৪৭০-৪৮০ ডলার হলে ২১ লাখ টন চিনির দাম কত হয়?, এটা হিসাব করলেই যে কেউ বের করতে পারেন।

অর্থাৎ চিনি বাবদ আমরা যা ব্যয় করছি, তার পুরোটাই যাচ্ছে বিদেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পকেটে।

বিষ কেনার জন্য হুড়াহুড়ি করা বোকামিরই প্রকাশ!

আবার কেউ কেউ আফসোস করেছেন এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম দ্বিগুণ হলেও ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে পণ্যটির ওপর থেকে কর-ভার কমানো হয়নি!

আসলে আমরা প্রশ্ন করছিলাম যে, চিনি এসেনশিয়াল কিনা? অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কিনা? চিনি না খেলে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে কিনা যে এটার জন্য আফসোস করতে হবে এটার জন্য সুপারিশ করতে হবে?

বাস্তব সত্য হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন- সাদা চিনি হলো ‘বিষ’। সুগারের বিকল্প ইংরেজি নাম হচ্ছে হোয়াইট পয়জন।

যে সুগারকে হোয়াইট পয়জন বলা হচ্ছে, যে সুগার শরীর ও মনের ওপর স্বাস্থ্যের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর যা শত শত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সেই বিষ কেনার জন্য হুড়াহুড়ি করা বা চিনি কিনতে না পেরে হা-হুতাশ করাকে বোকামি ছাড়া আর কি বলা যায়?

যেখানে মেদস্থূলতায় জর্জরিত হৃদরোগ ক্যান্সার ডায়াবেটিসে জর্জরিত ইউরোপ এবং আমেরিকার ধনী দেশগুলো চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয়ের ওপর অতিরিক্ত কর বসাচ্ছে যেটাকে বলা হয় সুগার ট্যাক্স। এই কর বসানোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষ যাতে চিনিযুক্ত খাবার কেনা কমিয়ে দেয়। সেখানে চিনির ওপর আমাদের দেশে কর হার কমানোর প্রস্তাব কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত আর কতটা অবিবেচনাপ্রসূত এটা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি।

গবেষকরা ডিপ্রেশনের সাথে চিনির স্পষ্ট যোগ খোঁজে পেয়েছেন!

চিনি নিয়ে আমরা এর আগেও আলোচনা করেছি। আমরা ৪ লাখ ৩০ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা রিপোর্টের উল্লেখ করে বলেছিলাম যে, উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার খাদ্যনালী ফুসফুস ফুসফুসের আবরণ ও ক্ষুদ্রান্ত্র এবং মহিলাদের জরায়ুর অভ্যন্তরভাগ ক্যান্সারের সাথে সরাসরি সংযুক্ত।

উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার ফ্যাটি লিভার সৃষ্টি করে যা ক্রমান্বয়ে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে। ব্লাড সুগার ও রক্তচাপ বাড়ায় ধমনিতে চর্বি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। ২৩০০ জন টিনেজারের ওপর পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মুখে ব্রনের কারণ হচ্ছে চিনিযুক্ত খাবার।

চিনিযুক্ত খাবার নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ ও প্রবাহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে গবেষকরা বিষণ্নতা ডিপ্রেশনের সাথে এর স্পষ্ট যোগ খোঁজে পেয়েছেন। ৬৯,০০০ নারীর ওপর এবং ৮০০০ নারী-পুরুষের ওপর পরিচালিত দুটি গবেষণায় একই ফল পাওয়া যায়।

চিনি কিডনির রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। চিনি দাঁতের মিনারেলের ক্ষতি করে মাড়িরও ক্ষতি করে দাঁতের এবং মাড়ির স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। চিনি রক্তের ইউরিক এসিডের লেভেল বাড়িয়ে দেয়, ফলে বাড়ে বাতের ঝুঁকি। চিনি ও চিনিজাত মিষ্টি বেশি খেলে স্মৃতিভ্রষ্ট স্মৃতি ভ্রষ্টতার ঝুঁকি বাড়ে বুদ্ধিদীপ্ততা কমে যায়।

আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি স্থূলজাতি হবার মূল কারণও এই চিনি!

অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে আমেরিকানদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কম। গড়পড়তা একজন আমেরিকান ২০ চা চামচ চিনি খায় প্রত্যেকদিন। অর্থাৎ চিনিজাতীয় খাবারের মধ্য দিয়ে চিনি গ্রহণের পরিমাণ হচ্ছে ২০ চা চামচ। এবং যে কারণে আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি স্থূলজাতি। তাদের মেদস্থূলতা সবচেয়ে বেশি! হার্ট হৃদরোগ ক্যান্সার ডায়াবেটিস বেশি এবং একইভাবে নিদ্রাহীনতা।

আমেরিকানদের এত অনিদ্রায় আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ এই চিনি। চিনি ঘুম কমিয়ে দেয়। রাতে দেহ অভ্যন্তরের অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয় যার ফলে আমেরিকানরা প্রায়শই অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। কারণ তারা রাতে ডিনার করে। এবং ডিনারের শেষ হচ্ছে ডেজার্ট দিয়ে। আর ডেজার্টের পুরোটাই তৈরি হয় অতিরিক্ত চিনি ব্যবহার করে।

ক্যান্সার আক্রান্তদের মিষ্টিজাতীয় খাবার পছন্দের কারণও চিনি!

আমরা আরও বলেছিলাম, এই যে ছোট বয়সের ছেলেমেয়েদের সিস্ট হচ্ছে টিউমার হচ্ছে এর একটা বড় কারণ চকলেট, মিষ্টি। কারণ এখনকার জেনারেশনের বাচ্চারা চকলেট খুব বেশি পরিমাণে খাচ্ছে। এটা যেরকম তাদের মেদস্থূলতা বাড়াচ্ছে, তেমনি তাদের সিস্ট বা টিউমারের কারণ হচ্ছে।

আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, ক্যান্সার আক্রান্ত যারা তারা সাধারণত মিষ্টিজাতীয় খাবার খুব পছন্দ করে। কেন? কারণ ক্যান্সারাস সেলগুলো তাদের শক্তি সংগ্রহ করে এই চিনি থেকে। আর সুগার এবং ফ্যাট দুটোরই মিশ্রণ হয়েছে চকলেট।

তাই যাদের কোথাও কোনোরকম সিস্ট আছে টিউমার আছে তাদের চিনির ব্যাপারে অনেক অনেক বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

আসলে চিনি নিয়ে যদি আমরা একটু গভীরভাবে ভাবি, তাহলে দেখব মানুষের জন্যে সভ্যতার জন্যে পারমাণবিক বোমার চেয়েও চিনির ক্ষতি এবং ধ্বংসের হার বেশি।

বোমায় মৃত্যুটা দৃশ্যমান কিন্তু চিনির প্রভাবের মৃত্যু নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন!

আপনার কাছে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব বিষয়টি কত সত্য। চিনি যেসমস্ত রোগের কারক তার মধ্যে একটি হচ্ছে হৃদরোগ।

এবং ওয়ার্ল্ড হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা রিপোর্ট হচ্ছে, প্রতিবছর বিশ্বে এক কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। স্ট্রোকে মারা যায় ৬৫ লক্ষ মানুষ এবং ডায়াবেটিসে মারা যায় ১৫ লক্ষ মানুষ।

আমাদের দেশে কোভিডে যারা মারা গিয়েছিলেন তার অর্ধেকই ছিলেন ডায়াবেটিস আক্রান্ত। আমরা ক্যান্সারে মৃত্যুর এবং অন্যান্য রোগে মৃত্যুর কারণ বাদ দিয়ে শুধু যদি দেখি যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যান তাদের সংখ্যা এক কোটি ৭৯ লাখ।

এবার আমরা দেখি যে, পারমাণবিক বোমায় কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকি দুটি শহরে দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেন। হিরোশিমায় সাড়ে তিন লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে এক লক্ষ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে ৭৪ হাজার মানুষ সাথে সাথে মারা যায়।

তারপরে বোমার তেজস্ক্রিয়জনিত কারণে হিরোশিমায় এবং নাগাসাকি মিলে মোট তিন লাখ ৭২ হাজার মানুষ মারা যায়।

পারমাণবিক বোমায় মৃত্যুটা দৃশ্যমান ছিল! সারা পৃথিবীর মানুষ ধিক্কার দিয়েছে, কিন্তু সাদা বিষ চিনি কোটি মৃত্যুর কারণ হওয়ার পরেও ধিক্কার দেয়া তো পরের কথা, আমরা অনেকেই এখনো সচেতন হয়ে উঠতে পারি নি। তাই আমরা বিষ কেনার জন্যে লাইনে দাঁড়াচ্ছি এবং আফসোস করছি যে আরো দাম কমিয়ে আমাদেরকে বিষ কেনার সুযোগ কেন করে দেয়া হচ্ছে না।

চিনিজাত খাবার কেউ আপ্যায়ন করলে কী করবেন?

প্রিয় সুহৃদ! জেনে-শুনে বিষ পান করা আর আত্মহননের পথ বেছে নেয়া দুটোর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।

প্রিয় সুহৃদ! ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে সবসময় কল্যাণের অনুরণন কল্যাণের বাণী কল্যাণের ডাক নিয়ে আসে।

এবারের ফেব্রুয়ারিতে আমরা যদি সাদা বিষ থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করতে পারি যে, না! যা আমার স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর, এই ক্ষতিকর চিনি-আসক্তি থেকে আমি নিজেকে বের করে নিয়ে আসব। এবং চিনি নিজে খাওয়া থেকে বিরত থাকব।

কেউ চিনিজাত জিনিস আপ্যায়ন করলেও তাকে বিনয়ের সাথে বলব যে, আমি চিনি খাই না! চিনির প্রতি আমার কোনো আসক্তি নাই। চিনির আসক্তি থেকে আমি পুরোপুরি মুক্ত। নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজেকে টোটালি ফিট করার জন্যে এটি একটি চমৎকার পদক্ষেপ হবে।

বাবা শিবানন্দ ছোটবেলা থেকেই চিনি খান না!

আপনি জানেন পৃথিবীর যিনি সবচেয়ে ফিট মানুষ সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ বাবা শিবানন্দ, ১২৬ বছর বয়স তার কোনো রোগ নাই!

এখনো তিনি সবদিক থেকে টোটালি ফিট। তিনি চিনি খান না সেই ছোটবেলা থেকেই। যার ফলে কোনো অসংক্রামক ব্যাধিতে তিনি কখনো আক্রান্ত হন নাই। আর আমরা জানি যে অসংক্রামক ব্যাধি সারা পৃথিবীতে এখন মৃত্যুর মুখ্য কারক।

এবং যারা চিনি বর্জন করতে চান তারা অনায়াসে ফেব্রুয়ারি মাসে চিনির ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে পারেন। যেখানে এক কিলো চিনি কিনতেন সেখানে আধা কিলো কিনেন।

এরপরের মাসে আড়াইশ গ্রাম কেনেন এবং একটা সময় দেখবেন চিনি আপনি বর্জন করতে পারছেন। চিনি বর্জন করলে যে জাতীয়ভাবে এই চিনি আমদানির খাত থেকে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা আমাদের যেরকম বেঁচে যাবে, একইরকমভাবে চিনিজাত খাবার খেয়ে যে রোগ হয়, সেই রোগগুলো আমাদের অনেক কমে যাবে এবং সেই খাতেও আমরা বার্ষিক ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা বাঁচাতে পারব। যা আমরা ব্যয় করতে পারব জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনন্য মানুষ দক্ষ মানুষ সুস্থ মানুষ দীর্ঘজীবী মানুষ হিসেবে গড়ার কাজে।

৭০ বছর আগে ফেব্রুয়ারি ছিল ইতিহাসের বাঁক বদলের কারক!

প্রিয় সুহৃদ! ৭০ বছর আগে ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাসের বাঁক বদলের কারক হয়েছিল। ৭০ বছর পরে আবার ফেব্রুয়ারি সাদা বিষ হোয়াইট পয়জন অর্থাৎ চিনি বর্জন করার মধ্য দিয়ে কর্মক্ষম দীর্ঘ সুস্থ সফল দীর্ঘজীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় টোটাল ফিটনেসের অনুঘটক হিসেবে কাজ করুক। সাধারণ মানুষের সুস্থ জীবনের পথে একটা বড় বাঁক বদল ঘটুক। নতুন একটা সুস্থতার ধারা সৃষ্টি হোক। পরম করুণাময়ের কাছে এটাই আমাদের প্রার্থনা।

কোনোকিছু অর্জন বা বর্জনের স্রোতেই বাঁক বদলাতে থাকে… এক্ষেত্রে আপনি নিজেকে কখনো একা বা ছোট মনে করবেন না। আপনি চিনিজাত খাবার মিষ্টিজাত খাবার কমিয়ে স্বাস্থ্য-সচেতনতার নতুন ধারার অনায়াসে অংশ হতে পারেন।

আসলে ছোট ছোট কাজ যখন একত্র হয় একজন একজন করে যখন কোনো কাজ করা হয় বা কোনোকিছু বর্জন করা হয় বা কোনোকিছু কমানো হয় আস্তে আস্তে স্রোত সৃষ্টি হতে থাকে আস্তে আস্তে স্রোত বাঁক বদলাতে থাকে।

পরম প্রভু আমাদের সবাইকে সুস্বাস্থ্যের এই বাঁক বদলের অনুঘটকে পরিণত করুন। এটাই আমাদের প্রার্থনা।

সবাই ভালো থাকুন। খোদা হাফেজ।

[৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সাদাকায়নের জন্য ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে গুরুজীর প্রদত্ত বক্তব্য]




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD