সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকা ২০০৯ সালে এক যৌথ জরিপ চালিয়ে জানিয়েছিল, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে; এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এরপর কেটে গেছে ১৪ বছর। এই সময়ে নিয়ম না মেনে গড়ে তোলা ভবনের সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। ভূমিকম্পের মত দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো বা উদ্ধার তৎপরতার প্রস্তুতি এগোয়নি খুব একটা।
এ সপ্তাহের শুরুতে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া তুরস্ক আর সিরিয়ায় ১৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার ভূমিকম্প-ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আনছে।
বাংলাদেশও যে ওই ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে আছে, সে কথা বার বার বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সত্যি সত্যি সেই বিপদ এলে কী ঘটবে, সে বিষয়ে আশাব্যাঞ্জক কিছু শোনাতে পারছেন না তারা।
ভূতাত্ত্বিকভাবে ভূমিকম্পের দুটি উৎস কাছাকাছি থাকায় যে কোনো সময় বাংলাদেশও এ ধরনের দুর্যোগে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বিধি মেনে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি না করায় অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। সত্যি সত্যি সেরকম কিছু ঘটলে অপ্রশস্ত রাস্তার কারণে দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধারকাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
বিপদের উৎস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মত দুটি উৎস আছে। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের সাবডাকশন জোন এবং ডাউকি ফল্ট, যার পূর্বপ্রান্ত সুনামগঞ্জ থেকে থেকে জাফলং পর্যন্ত বিস্তৃত।
“এ দুটি উৎস থেকে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। সাবডাকশন জোনে ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি গত ৮শ থেকে হাজার বছর সেখানে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তার মানে যে শক্তি জমা হয়ে আছে, তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে ৮ দশমিক ২ বা বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে।
“আর ডাউকি ফল্টের ওই এলাকায়ও চার থেকে পাঁচশ বছর কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। সেখানে সাত থেকে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। আজ, কাল বা ৫০ পর হোক, ভূমিকম্প একদিন হবেই।”
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূমিকম্পের এ দুটি উৎসের খুব কাছে দেশের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র এবং বড় বড় শিল্প স্থাপনা রয়েছে। রাজধানী ঢাকাও উৎসের খুব কাছে। ফলে তার ভাষায়, ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ানোর জন্য যতগুলো উপাদান দরকার, তার সবগুলোই এখানে উপস্থিত।
“ঢাকায় ৬ লাখের বেশি ইমারত আছে। এদের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, ঝুঁকিপূর্ণ। বড় ধরনের ভূমিকম্প যদি হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতিটা এখানেই বেশি হবে। একটা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ঢাকা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলা যাবে না। এ কারণে এই ঝুঁকি সহজেই কমার সুযোগ নেই।”
২০১৮ সালের এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারের একটি জরিপে রাজউক এলাকার ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি হাজার ভবনে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯২৫টি ভবন, অর্থাৎ ৬৬ দশমিক ১ শতাংশই অনুমোদনহীন।
১৮৭০ সালের পর বাংলাদেশ অঞ্চলে আর বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। সে কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং সরকার বিষয়টি নিয়ে ‘তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না’ এবং সে কারণে প্রস্তুতিও দুর্বল রয়ে গেছে বলে মনে করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি বলেন, ভূমিকম্প মোকাবেলায় এটি ‘বড় সমস্যা’।
“আমাদের প্রস্তুতি খুব দুর্বল। তুরস্কে যেসব ভবন ভেঙে গেছে, তার মানে সেগুলোতে এনফোর্সমেন্টে প্রবলেম ছিল। আমাদের এখানে এই সমস্যা আরও বেশি, অনেক ভবন বিল্ডিং কোড মেনে হয়নি।
“ভূমিকম্পে ভবন ভেঙে গেলে মানুষ মারা যায় বেশি। একই ঘটনা আমাদের এখানেও ঘটবে, আরও বেশি মানুষ মারা যাবে। কারণ আমাদের পপুলেশন বেশি। বিল্ডিংকোড এনফোর্সমেন্ট আমাদের এখানেও অত স্ট্রং না।”
রাউজকের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় সাতের বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং শুধু ইটের তৈরি যেসব ভবন, সেগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাছাড়া বালু দিয়ে জলাশয় ভরাট করে তৈরি ভবনগুলোও ঝুঁকিতে থাকবে।
“জলাশয়ের ওপর করা ভবনগুলোর নিচের মাটি শক্ত না। ঝাঁকুনি এলে সয়েল লিকুইফিকেশন ইফেক্টের কারণে ভবন দেবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজউক এখনও পর্যন্ত শুধু ভবনের স্থাপত্য নকশা দেখে অনুমোদন দেয়। ভবনের কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল) নকশা বাধ্যতামূলক করার সময় এসেছে।
“স্থপতি যে ডিজাইন দিয়েছে সে অনুযায়ী ঠিকমত হচ্ছে কিনা তা দেখা হচ্ছে না। যে পরিমাণ রড, সিমেন্ট, বালি প্রেসক্রাইব করেছে, সেটা ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তাও মনিটর করা হচ্ছে না। এখন ভূমিকম্প বাড়ছে। এ কারণে ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন বাধ্যতামূলক করার সময় এসেছে।”
নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটা তা নির্ভর করে ভূমিকম্পের মাত্রা এবং অবকাঠামো কতটা ভূমিকম্প সহনশীল, তার ওপর। ঢাকার বেশিরভাগ ভবনের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল। পাশাপাশি ২০০০ সালের পর থেকে গড়ে ওঠা নতুন আবাসিক এলাকাগুলো ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে।
“বসিলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বনশ্রী, আফতাবনগর– এসব জলাশয়, জলাভূমি ভরাট করে বালি বা কাদামাটির ওপর করা হয়েছে। এ কারণে ভালনারেবলিটি অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আবার পুরান ঢাকায় মাটি ভালো হলেও অবকাঠামো ভালো না হওয়ায় ঝুঁকি থাকছে। তবে ধানমণ্ডি, বনানী, গুলশান এলাকায় মাটির কোয়ালিটি ভালো, ভবনও ভালো। সে কারণে সেখানে ঝুঁকি কিছুটা কম।”
অপ্রশস্ত সড়কের ফাঁদ
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ ২০২২ অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরী এলাকায় মোট রাস্তার মাত্র ১০ শতাংশের প্রস্থ ২০ ফুট বা তার বেশি। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ রাস্তা ২০ ফুটের কম চওড়া।
এসব অপ্রশস্ত রাস্তা ভূমিকম্প বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বড় বাধা তৈরি করবে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
বুধবার তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা বাড়লেও শুধুমাত্র অপ্রশস্ত সড়কের কারণে সব জায়গায় সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় না। একই কথা প্রযোজ্য ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও।
ভূমিকম্প: ঢাকা কতটা প্রস্তুত?
“পুরান ঢাকা এবং অপরিকল্পিত এলাকার ৭০ শতাংশ রাস্তাই সরু। ফলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য আমরা পৌঁছাতেই পারব না। এটাই চিন্তার বিষয়।”
তিনি বলেন, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা প্ল্যান অনুমোদন করতে হলে ভবনের নকশায় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয় আছে কিনা তা পরীক্ষা করেন তারা। ভবন নির্মাণের পরে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করতে গিয়ে তারা দেখেছেন, অনেককিছুই উপেক্ষিত থেকেছে।
“ভবন মালিকরা বিষয়গুলো মেনে চলেন না। এজন্য আমরা ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করি। সঠিক পরিসংখ্যান বলতে পারব না, তবে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভবনই এই ঝুঁকির মধ্যে আছে।”
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনও বুধবার এক অনুষ্ঠানে এ নিয়ে কথা বলেন। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে যে কোনো দুর্যোগে উদ্ধার কাজ যে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে, তার কথায় সেই বার্তাই উঠে আসে।
তিনি বলেন, “আমাদের জন্য সত্যিই একটা ঝুঁকি। পুরান ঢাকার মত যে জায়গাগুলো আছে, সেখানে আমরা হয়ত প্রশিক্ষিত জনবল থাকব, ইকুইপমেন্ট থাকবে, কিন্তু আমরা পৌঁছতে পারব কি?”
মহাপরিচালক বলেন, “আরেকটি বিষয় আমাদের একটু লক্ষ্য রাখা দরকার, আমাদের মাটির নিচে সুয়ারেজ সিস্টেম আছে, গ্যাস সিস্টেম আছে, ইলেক্ট্রিসিটি সিস্টেম আছে, যখন ভূমিকম্প হবে তখন এগুলোর কী হবে? এই আজকের সেবামূলক সিস্টেমগুলোই কিন্তু আমাদের জীবননাশের হুমকি হবে।” [bdnews24]