চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমেছে। মূল বাজেটে এডিপির মোট আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি। কিন্তু করোনা ও দীর্ঘমেয়াদি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে তৈরি হওয়া নানামুখী সংকটের প্রভাবে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বড় ধরনের ভাটা পড়ে। বিশেষ করে বৈদেশিক অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পগুলোর সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থা। এমন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে সরকার অর্থবছরের সাত মাস পেরোতেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি কাটছাঁট করার পথে হাঁটল।
এবার সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে মূল বাজেটে রাখা এডিপির আকার সংশোধনী পর্যায়ে কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। তবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের প্রায় ৮ হাজার ৯৯৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকাসহ সংশোধিত নতুন এডিপির আকার দাঁড়াবে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপির অনুমোদন করেন এনইসি চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে সংশোধিত এডিপির বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও পরিকল্পনা সচিব সত্যজিৎ কর্মকার।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জানান, সংশোধিত পর্যায়ে এডিপির আকার কমিয়ে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে শুধু বৈদেশিক বরাদ্দই কাটছাঁট করা হয়েছে, যার পরিমাণ ধরা হয় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মূল এডিপিতে ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। বরাদ্দ কমানোয় বৈদেশিক অর্থায়নের আকার দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে সংশোধন পর্যায়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন থাকবে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা অপরবর্তিতই রাখা হয়েছে। মোট ১৫২৫ প্রকল্পের বিপরীতে সংশোধিত অর্থ বরাদ্দ পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
দেশের অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে শামসুল আলম বলেন, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে টানা মূল্যস্ফীতি কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এনইসি সভায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘ফসল উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেসব প্রকল্পে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে এবং যেসব প্রকল্পের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, সেসব প্রকল্পে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনবলের অভাবে যাতে প্রকল্পের নির্মাণকৃত ভবন পড়ে না থাকে, সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
সংকটের সময়েও বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে বরাদ্দ কমার বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, এ বিষয়ে আজ এনইসি সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পগুলোতে গতি বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়েছে। যাতে এই সংকটের সময়ে ডলার কাজে লাগানো যায়।
পরিকল্পনা সচিব বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এ বছরেও দেশের সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ খাত, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রকল্পগুলোতে যে চাহিদা ছিল, তার তুলনায় বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরএডিপিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। আর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ২ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা সচিব বলেন, যেহেতু বরাদ্দ নির্ধারিত ছিল, সে কারণে মন্ত্রণালয়গুলো বেশি চাহিদা প্রস্তাব দিতে পারেনি। কিন্তু পরে তারা বরাদ্দ বাড়ানোর চিঠি দিয়েছেন। যেহেতু পরিকল্পনা কমিশনের কাছে টাকা ছিল, তাই ওইসব মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। আর সবচেয়ে কম পেয়েছে সেতু, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ। স্থানীয় সরকার বিভাগ পেয়েছে ৩৯ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। ২৯ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা পেয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ২৫ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা পেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। রেলপথ মন্ত্রণালয় পেয়েছে ১২ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পেয়েছে ১১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পেয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ পেয়েছে প্রায় ৭ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পেয়েছে ৯ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।
এমআরটি-৬, পদ্মা রেল সেতু ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও অন্য মেগা প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে যা কমে হচ্ছে ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূল এডিপিতে রাখা ছিল ১৩ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ কমে হচ্ছে ১১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে বিদেশি অংশ কমেছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অন্যদিকে বেড়েছে দেশীয় অংশ।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বরাদ্দ ৩ হাজার ৭০২ কোটি থেকে কমে হচ্ছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুমুখী সড়ক টানেল প্রকল্পে বরাদ্দ ২ হাজার কোটি থেকে কমে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা হচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পের বরাদ্দ ১ হাজার ৪৫০ কোটি থেকে কমে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা হচ্ছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ১৯ কোটি টাকা। আরএডিপিতে তা কমে হচ্ছে ৪ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর জন্য মূল এডিপিতে ছিল ৩ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। আরএডিপিতে তা কমে হচ্ছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের বরাদ্দ হচ্ছে ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা।