সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফেণের কয়েকটি ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্ঘটনার আগে আইন প্রয়োগকারী কোনও সংস্থাই তদারকি করে না বলে অভিযোগ ফায়ার সার্ভিসের। সংস্থাটি বলছে, বিভিন্ন ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ আমলে নেয় না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করোপরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীতে দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন-মার্কেটের অনুমোদন না থাকা বা ঝুঁকিপূর্ণ থাকার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
এছাড়াও আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিংয়ে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন। সেখানে সব দফতরের কাজের হিসাব ও পরিকল্পনা শোনেন আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে সেসব পরিকল্পনার বেশিরভাগই কাগজেই বন্দি থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীতে কোনও অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটলেই রাজউক ও সিটি কপোরেশনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অবৈধ ভবনের তালিকা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্ত সেটার বাস্তব কর্মকাণ্ড আর চোখে পড়ে না কারও। এতে করে একই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটে চলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার সঙ্গে এমওইউ চুক্তি আছে ফায়ার সার্ভিসের। যেকোনও প্রয়োজনে তারা ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেন। বঙ্গবাজারের আগুনে ওয়াসা প্রচুর পানি দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তারা চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরার্মশ বা সুপারিশ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস এই সংস্থাগুলোকে কোনও কিছু করতে বলতে পারে না।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশান ২-এ একটি ১২ তলা ভবনের আগুন চার ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট, সঙ্গে ছিল বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আগুন, পরে গত ৫ মার্চ ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকার একটি ভবনে বিস্ফোরণ। তার দুই দিন পরে ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইনে বিস্ফোণে ২৬ জনের মৃত্যু হয় ও শতাধিক আহত হন। ২৭ মার্চ রাজধানীর মহাখালীতে সাত তলা বস্তি ও কাপ্তানবাজারের জয়কালী মন্দির সংলগ্ন সুইপার কলোনিতে আগুন লাগে। সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব হয়ে যান হাজার হাজার ব্যবসায়ী।
২০২২ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আবাসিক, বাণিজ্যিক, হাসপাতাল, শিল্পকারখানাসহ অন্যান্য বহুতল ভবন পরিদর্শন করে। রাজধানীসহ সারাদেশে সংস্থাটি সরকারি ও বেসরকারি ৫ হাজার ৮৬৯ ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে সরকারি ১৩৩৭টি ও বেসরকারি ৪৫৩২টি ভবন রয়েছে। এসবের মধ্যে অগ্নি নিরাপত্তায় সন্তোষজনক সার্টিফিকেট দেওয়া হয় ৩ হাজার ৯৭টি ভবনকে। আর অগ্নি নিরাপত্তায় ‘ঝুকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয় এক হাজার ৬০৬টি ভবন। এছাড়া ৬১৭ ভবনকে অগ্নি নিরাপত্তায় ‘অতি ঝুকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয়।
এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, অগ্নি নিরাপত্তায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় সবার ওপরে চট্টগ্রাম বিভাগ, ৪৬৩টি ভবন। এরপর ঢাকা বিভাগ ১৩৬টি। কিন্তু অগ্নি নিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা ভারি ঢাকা বিভাগে, ৪৯৯টি। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম বিভাগ ৪৭৭টি। অগ্নি নিরাপত্তায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় সন্তোষজনক অবস্থানে আছে ময়মনসিংহ বিভাগ। তারপর সিলেট ও রংপুর বিভাগ।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে অগ্নি নিরাপত্তায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মার্কেটের তালিকা ধরে পরিদর্শন করার জন্য ফায়ার সার্ভিস সাতটি টিম গঠন করেছে। এর মধ্যে একটি বিশেষ টিম রয়েছে। তারা রাজধানীর সব মার্কেট পরিদর্শনের কাজ শুরু করেছে। মে মাসের মধ্যে ভবন ও মার্কেট অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে পরিদর্শনের কাজ শেষ করা হবে। এবার ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে এনএসআই-ডিজিএফআইয়ের গোয়েন্দারা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিদর্শনে অংশ নিচ্ছেন। তাদের পরিদর্শন করা ভবন ও মার্কেট সম্পর্কে রিপোর্ট করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি নিরাপত্তায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল– বঙ্গবাজার মার্কেট, রাজধানী মার্কেট, গুলিস্তান, পাতাল মার্কেট, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, সদরঘাট গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ ও পোশাক মার্কেট, খিলগাঁও তালতলা সুপারমার্কেট, মোহাম্মদপুর টাউন হল মিলনায়তন ও শপিং কমপ্লেক্স মার্কেট, কাওরান বাজারের কাঁচাবাজার মার্কেট ও গুলশান কাঁচাবাজার মার্কেটসহ আরও কিছু মার্কেট ও আবাসিক ভবন।
গত বছর আবাসিক বহুতল ভবন, শপিংমল ও মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ২৬৩টি। যা ওই বছরের যত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার প্রায় এক-তৃতীয় অংশের সমান। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩০ টাকা। আর উদ্ধারের পরিমাণ ৬৪২ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার ৮০২ টাকা।
গত বছর রাজধানীতে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা সংক্রান্ত নকশা অনুমোদন ও অনাপত্তি ছাড়পত্র সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রস্তাবিত ভবনের অনাপত্তি ছাড়পত্র দেওয়া হয় ৯৪৬টি। আর বিদ্যমান ভবনের অনাপত্তি ছাড়পত্র দেওয়া হয় ৯৩৩টি।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং মার্কেটের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সতর্কবার্তা ও সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কিসের জন্য সেসব বাস্তবায়ন হয়নি সেটা বলতে পারেন না তারা। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় রাজউক, সিটি কপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিংও করা হয়েছে। সেখানে অগ্নি নিরাপত্তায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বিষয়টি তুলে ধরা হলেও পরে সেটা আর কাজে আসে না।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, রাজধানীতে অগ্নিনিরাপত্তায় ১৩৬টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৪৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মার্কেটের বিষয়ে মিটিংগুলোতে জানানো হয়েছে। এছাড়া সরাসরি ভবন ও মার্কেটগুলোতে অনেক বার নোটিশ করা হয়েছে। একটি নোটিশে একটি টাইমলাইন দেওয়া হয়। সে সময় চলে যাওয়ার পরে পরিদর্শন করে আবার ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও কাজে আসছে না এসব সর্তকবার্তা, নোটিশ ও সুপারিশ। একটি ঘটনা ঘটার আগে সেটার নিরাপত্তার বিধান করাই সবার কাজ। কিন্তু সেটাই হচ্ছে না। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে হায়হুতাশ করে কোনও লাভ হয় না।
বঙ্গবাজার মার্কেট সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, এই মার্কেটের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশন। এখানে ফায়ার সার্ভিস সরাসরি সিটি কপোরেশনকে নোটিশ করতে পারে না। মার্কেট ব্যবস্থাপনা কমিটিকেই নোটিশ করা হয়। কিন্তু তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। অনেক ভবন আছে যেটা রাজউকের আওতাধীন। সেখানে রাজউককে সরাসরি নোটিশ করা যায় না। ফায়ার সার্ভিস ভবন মালিককে নোটিশ করা হয়। এছাড়া কিছু বিষয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবগত করা হয়।
ডিএসসিসির আঞ্চলিক-১ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন বলেন, অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও বঙ্গবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ছয় বার নোটিশ দেওয়া হয়েছে উঠে যাওয়ার জন্য। কারণ ১৯৯৫ সালে অগ্নিকাণ্ডের পরে ওখানে ভবন নির্মাণের জন্য প্ল্যান পাস হয়ে ঠিকাদারও নিয়োগ হয়ে গেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা হাইকোটে রিট করায় পরে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মার্কেটকে বার বার নোটিশ ও সর্তকবার্তা দেওয়ার পরেও আমলে না নিলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কী ধরনের আইনের পদক্ষপ নিতে পারেন জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বাংলা বলেন, ফায়ার সার্ভিস কোনও আইনি পদক্ষপ নিতে পারে না। কর্তৃপক্ষকে জানানো ছাড়া কিছুই করার নেই। এছাড়া রাজউকের সঙ্গে বার বার এবিষয় নিয়ে কথা হয়। নতুন করে আবারও আগামী সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের মিটিংয়ে বসার কথা রয়েছে।
ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বলেন, ফায়ার সার্ভিস আইনে যেটুকু কাভার করে সে অনুযায়ী অগ্নিঝুঁকি রয়েছে এমন সব ভবন ও মার্কেটের মেইন গেটে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ অগ্নিঝুঁকি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এরপরেও যেসব সংস্থা বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিশ বা সর্তকবার্তা তাদের দেওয়া হয়নি, তাদের বলবো যখন কোনও ভবন ও মার্কেটের মেইন গেটে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগানো হয়। সেটা রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো দেখে না! ফায়ার সার্ভিস আইনে যেটুকু কভার করে, সে কাজ করে যাচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মার্কেটে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।