রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার থেকে নেয়া ঋণ চীনের মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বাস্তবতায়, মার্কিন ডলারের বদলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হয়েছে উভয় দেশ।
সম্প্রতি রূপপুর কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধের বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাথে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈশ্বিক পেমেন্ট চ্যানেল- সুইফট থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে– গত বছরের মার্চে অর্থ পরিশোধ স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিল মস্কো।
নতুন সমঝোতার আওতায়, বাংলাদেশ একটি চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে পেমেন্ট নিষ্পত্তি করবে, আর চীনের সিআইপিএস বা ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম এর মাধ্যমে রাশিয়ান পক্ষ অর্থ বুঝে পাবে। সুইফটের একটি সীমিত পরিসরের বিকল্প হলো ইউয়ান-ভিত্তিক লেনদেন নির্ভর সিআইপিএস।
অন্যদিকে, নিরাপদভাবে বৈশ্বিক ব্যাংকিং খাতের লেনদেনের বার্তা আদানপ্রদানকারী প্ল্যাটফর্ম হলো বেলজিয়াম-ভিত্তিক সুইফট।
এর আগে, ২০২০ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশের সাথে মুদ্রা অদলবদলের প্রস্তাব দেয় মস্কো। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে পিছিয়ে আসে।
এরপর রাশিয়ার তৈরি পেমেন্ট চ্যানেল- সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফিন্যান্সিয়াল ম্যাসেজেস (এসপিএফএস)- এ বাংলাদেশকে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের অংশ হয়ে ওঠা ইউয়ানে বাণিজ্য নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয় রাশিয়াকে।
এর প্রতিক্রিয়ায়, রাশিয়া দাবি করে ইউয়ানকে রুপান্তরের সময় তাদের মূল্যগত লোকসান হবে, যা দিতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে উভয় দেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিষ্পত্তি চীনের মুদ্রা ইউয়ানে (যা রেনমিনবি নামেও পরিচিত) করতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ঋণ পরিশোধ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় – কোন ব্যবস্থায় পেমেন্ট করা হবে সে বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রস্তাবনা ইআরডিতে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় এবিষয়ে আরো বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেন তিনি।
ইআরডির সভা সূত্রে জানা যায়, রূপপুর প্রকল্পের জন্য দেওয়া মোট প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিপরীতে ৩১৮ মিলিয়ন ডলারের একটি কিস্তি পরিশোধ মুলতুবি আছে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বার্ষিক বরাদ্দকৃত ঋণের অংশ অব্যবহৃত থাকলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২.৫ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক প্রতিশ্রুতি ফি প্রদান করবে।
রাশিয়া সাথে ঋণচুক্তি অনুসারে, বরাদ্দকৃত ঋণের অব্যবহৃত অংশের জন্য বাংলাদেশকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রতিশ্রুতি ফি দিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাশিয়ান ঠিকাদার যদি বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থ হয়- তার জন্য বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি ফি দিতে হবে।
রাশিয়ান ঠিকাদাররা বরাদ্দকৃত অংশ ব্যয় করতে না পারায় প্রতিবছর বাংলাদেশকে প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট ফি দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো দোষ না থাকার পরও এটি দেশের জন্য বড় ধরনের মূল্য প্রদানের ঘটনা।
এই প্রেক্ষাপটে, ফির পরিমাণ যতই বাড়ুক প্রতিবছর সর্বোচ্চ ২.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ঋণ-সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া; একইসঙ্গে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন- রোসাটমের একটি ঠিকাদার এটির বাস্তবায়ন কাজ করছে।
এরমধ্যেই সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের কিছু অংশ পরিশোধ করা শুরু হয়।
বাংলাদেশে কর্মরত রাশিয়ান কর্মীদের বেতনভাতাও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। তবে, সুইফট থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর এসব রাশিয়ান ব্যাংক সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
যেভাবে পেমেন্ট দেওয়া হবে
চীনা ব্যাংকে ইউয়ানে পেমেন্ট করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান প্রাপক তাদের নিজস্ব খরচে ইউয়ানকে রুবলে রুপান্তর করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, পরিশোধের জন্য সিআইপিএস চ্যানেল ব্যবহার করা হবে, যেহেতু ইতোমধ্যেই এটি মস্কোর সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে বেইজিং।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোকে তাদের সংশ্লিষ্ট বিদেশি শাখায় আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদেরও ‘এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা’য় (ইআরকিউ) নিজ অ্যাকাউন্টে চীনের মুদ্রা ইউয়ান রাখার অনুমতি দিয়েছে।
গত বছর চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং নিষ্পত্তির মাধ্যম হিসেবে রেনমিনবি ও টাকা উভয় মুদ্রা ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নার মধ্যে উভয় মুদ্রা অদলবদলের মাধ্যমে যা করা হবে। তারপরই এসব সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে বিশ্বজুড়ে দ্রুত স্বীকৃতি পাচ্ছে ইউয়ান। আর তাই বাংলাদেশ ব্যাংকও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের অংশ কমিয়ে ইউয়ানের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইউয়ানের পরিমাণ ২০১৭ সালের ১ শতাংশের তুলনায় গত বছরের আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৩২ শতাংশে। অন্যদিকে, একই সময়ে রিজার্ভে আধিপত্য করা মার্কিন ডলারের পরিমাণ ৮১ শতাংশ থেকে কমে ৭৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে।
২০১৬ সালে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এর স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) মুদ্রা ঝুড়িতে ইউয়ান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে ইউয়ানের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে।
মার্কিন ডলার, ইউরো, জাপানিজ ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের পাশাপাশি পঞ্চম মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানকেও এসডিআর- ঝুড়িতে অন্তর্ভুক্ত করেছে আইএমএফ। এসডিআর- ঝুড়িতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থই হচ্ছে– ইউয়ান বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রূপান্তরযোগ্য বা লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত একটি মুদ্রা।
বর্তমানে এসডিআর- বাস্কেটে মূল্যের দিক থেকে মার্কিন ডলার এবং ইউরোর পরেই তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীনের মুদ্রা ইউয়ান।
এর কিছু কাল পর- রিজার্ভ ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও ইউয়ানকে অনুমোদিত মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে– ফরেক্স রিজার্ভে চীনা মুদ্রাটির পরিমাণ বাড়াতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আলুসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির বিষয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনা করছে বাংলাদেশ, যার মূল্য চীনা মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে।
চলতি বছর পুনরায় রাশিয়ায় আলু রপ্তানি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ, তবে পেমেন্ট চ্যানেল ঘিরে অনিশ্চয়তার কারণে তা চূড়ান্ত করা যায়নি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে দেশটিতে বিপুল পরিমাণ আলু রপ্তানি করা হতো। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়তায় আমরা আবারো রপ্তানির উদ্যোগ নিচ্ছি’।
বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটাস্কির সাথে বৈঠকের পর এ মন্তব্য করেন তিনি।
এসময় মন্ত্রী বলেছিলেন, রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে আলুর পাশাপাশি আম, ফুলকপি ও বাঁধাকপি আমদানিতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
নিক্কেই- এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, এক বছর আগে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকেই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে ডলার ও ইউরো প্রাপ্তি সীমিত হয়েছে রাশিয়ার। ফলে তখন থেকেই আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য রুবল ও ইউয়ানের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধের কারণে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন্স (সুইফট) গত মার্চে বেশ কয়েকটি প্রধান রাশিয়ান ব্যাংককে তাদের বৈশ্বিক লেনদেন নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়া তার মোট রপ্তানি আয়ের মাত্র ৩৪ শতাংশ মার্কিন ডলারে পেয়েছে, ইউরোতে পেয়েছে ১৯ শতাংশ। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগে, জানুয়ারিতে যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫২ ও ৩৫ শতাংশ।
রাশিয়ার রপ্তানিকৃত গ্যাসের কিছু পেমেন্ট এখনও ডলার ও ইউরোতে দেওয়া হচ্ছে গ্যাজপ্রমোব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। সুইফট নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই গ্যাজপ্রম। তবে দিন দিন মূল্য পরিশোধে ইউয়ান ও রুবলের ব্যবহার বাড়ছে, সেপ্টেম্বর নাগাদ যার পরিমাণ ছিল ৪৭ শতাংশ।
চীনে গ্যাস রপ্তানির মূল্য ইউয়ান ও রুবলে নিচ্ছে গ্যাজপ্রম। ইউরোপের কিছু আমদানিকারকও রুবলে মূল্য পরিশোধ করছে।
রাশিয়ার জ্বালানি তেলে ইউরোপীয় দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার ফলে পণ্যটির রপ্তানি বেড়েছে এশিয়ায়। এতে করে, রাশিয়ার ইউয়ান-নির্ভরশীলতা নতুন গতি লাভ করেছে। TBS