আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শে বাজেট পেশ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পুরোটাই গরিব মানুষের জন্য বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
শুক্রবার (২ জুন) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আপনারাই আগে বলতেন এ দেশে মিডিল ইনকাম জনসংখ্যার হার বেশি, কিন্তু তারা ট্যাক্স দেয় না। এরা সবাই যদি ট্যাক্স দিতে তাহলে অন্যদের ভাগে কম ট্যাক্স দিতে হত। আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে সবাইকে ট্যাক্স দিতে হবে।
বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে সরকার আইএমএফের দেওয়া শর্তের ভিত্তিতে বাজেট প্রণয়ন করেছে- এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাদের প্রেসক্রিপশনে বাজেট করিনি। তাদের পরামর্শের যেটুকু গ্রহণ করা যায় সেটুকু করবো। সেখানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে যারা কাজ করে সেটি ভালো। তারা শুধু অর্থ দিয়ে সাহায্য করে না, অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংস্কারে সহায়তা করে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখারও থাকে।’
তিনি বলেন, আমরা এখন বিশ্বের সবার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেউ আলাদাভাবে বসবাস করার কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। আপনি যদি আমদানি করেন, তাহলেও কাউকে লাগবে, রফতানি করলেও কাউকে লাগবে।
সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও গত এক বছরে একজনও কালো টাকা সাদা করেননি বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলাম, কেউ যদি অপ্রত্যাশিত টাকা দেশে নিয়ে আসে, তাহলে সেই টাকার কোনো কর দিতে হবে না। গত বাজেটে এ সুযোগটি দেয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রত্যাশিত টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাই এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি।’
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। সারাবিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতিতে আছে। আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারবো না। মানুষকে খাবার না দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ছাড় দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছি। পাশাপাশি যেসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেখানে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে সাহায্য করছি। এভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছি।’
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। পরের ১০ বছরে সেটি ৬ শতাংশে নেমে আসে। সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি।.
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, পুরো বাজেটই গরিব মানুষের জন্য উপহার। এ দেশে অনেক মধ্য আয়ের মানুষ আছে, সময় এসেছে তাদের ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হবে। যারা আয় করেন ট্যাক্স দেওয়ার সক্ষমতা আছে তাদের ট্যাক্স দিতে হবে।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাজেটে যেসব কমিটমেন্ট বা অঙ্গীকার দিয়েছি সবগুলো পূরণ করেছি। ২ কোটি ৪৫ লাখ চাকরির ব্যবস্থা করেছি। ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান বাড়ছে। কর্মসংস্থানের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ মর্যাদার জায়গায় এসেছে। ভালো ভালো শিল্প কারখানা গড়ে তুলছি।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) শুধু লোন দেয় না, তারা সার্বিক পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ নিলে সফল হবেন বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, আইএমএফের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সবার সার্বিক বিষয়ে তারা দেখে। তারা শুধু লোন দিয়েই সাহায্য করে না, কিছু প্রজেক্টও সাজেস্ট করে। কোন কোন বিষয় বাস্তবায়ন করা যাবে সেগুলোও তারা পরামর্শ দেয়। আমি মনে করি তাদের পরামর্শ শুনলে সফল হবো।
বাজেটে আইএমএফের প্রভাব প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাই এখন অ্যালায়েন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমরা কোনো পণ্য না পেলে খুঁজি বিকল্প কোন দেশে সেটি পাওয়া যাবে। সার্বিক বিষয়ে আইএমএফের ওভারঅল প্রেসক্রিপশন থাকে। তবে সেখান থেকে যেটুকু গ্রহণ করা যায় করবো। বাকিসব আমরা আমাদের মতো করবো।
রিটার্ন দাখিল করলে দুই হাজার টাকা কর দেওয়া বাধ্যতামূলক প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, এটি আমি অনুরোধ করবো দেখে নিন কাদের টিআইএন আছে। টিআইএন বাধ্যতামূলক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য, গাড়িসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। গরিব মানুষের জন্য তো টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়। তাই আমি মনে করি তাদের দুই হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার।
বর্তমান সরকার দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুক্রবার (২ জুন) বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
কর্মসংস্থান বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত যেসব কমিটমেন্ট আমি দিয়েছি, সবগুলো পূরণ করেছি। আমি বলেছি দুই কোটি মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করবো, কিন্তু আমরা দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, চাকরিপ্রার্থীও বেড়েছে। তবে এখন কর্মসংস্থানও বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন দেশ পরিচালনা শুরু করি, তখন ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতাম, সেটি দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে পেরেছি। সুতরাং এবারও আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবো।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, পুরো বাজেটই গরিব মানুষের জন্য উপহার। এ দেশে অনেক মধ্য আয়ের মানুষ আছে, সময় এসেছে তাদের ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হবে। যারা আয় করেন ট্যাক্স দেয়ার সক্ষমতা আছে তাদের ট্যাক্স দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, আপনারাই আগে বলতেন এ দেশে মিডিল ইনকাম জনসংখ্যার হার বেশি, কিন্তু তারা ট্যাক্স দেয় না। এরা সবাই যদি ট্যাক্স দিতে তাহলে অন্যদের ভাগে কম ট্যাক্স দিতে হত। আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে সবাইকে ট্যাক্স দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদকালের ১৪ বছরে দেশে একজন মানুষও না খেয়ে মারা যাননি বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘২০০৬-০৮ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ হতো। উত্তরবঙ্গে অনেক মানুষ না খেয়ে মারা যেতেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৪ বছরে একজন মানুষও না খেয়ে মারা যাননি। আপনাদের (সাংবাদিক) নিউজেও এমন তথ্য দেখিনি। অথচ একটা সময় প্রতি বছর নভেম্বর ৮-১০ জন না খেয়ে মারা যেতেন।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা খাদ্যবান্ধব নানা কর্মসূচি করছি। এক কোটি পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছি। টিসিবির মাধ্যমে তেল-চিনি দেওয়া হচ্ছে। বাজেটের পরও চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একজন মানুষও যেন কষ্ট না পান, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।’
পণ্যের দাম বাড়লেও অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো বলে মনে করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মন্ত্রী বলেন, সারা পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখবেন, আমরা কোন অবস্থায় আছি। নিম্নআয়ের মানুষের কিছু কষ্ট হচ্ছে, এটা অর্থমন্ত্রীও বলেছেন। আমরা কিন্তু এটি মাথায় রেখে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ডাল-চিনি দিয়েছি। পেঁয়াজের দাম যখন বেড়েছে আমরা কমদামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। টিপু মুনশি বলেন, আমরা আশা করছি সামনে আরও ভালো কিছু হবে। তবে অন্যদের তুলনায় দেখলে আমরা ভালো আছি।
বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যেসব পণ্য ইম্পোর্ট করি তার দাম যদি বাড়ে বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে। সরকারের এই ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা নানা সমালোচনা করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, এ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে কোনো সমস্যা হবে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতিও বাড়বে না। গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সংকট মোকাবিলায় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। তার মানে ২ লাখ কোটি টাকা বাজেট থেকে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকে গেছে। এই টাকা যদি বাজারে থাকতো তাহলে সরকারের এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়া কোনো বিষয় হতো না। এখন যেহেতু বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে, সেজন্য সরকার বন্ডের মাধ্যমে নিচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ২ লাখ কোটি টাকা তুলে এনে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়লে টাকার সরবরাহ (ক্যাসেল আউট) কম থাকছে। পুঁজিবাজারের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কোন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ না থাকলেও বাজার গতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রিয় ব্যাংক ও সরকার সেটি নিয়মিত করে যাচ্ছে।
প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের চূড়ান্ত আকার (ব্যয়) ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ৫.২ শতাংশ। বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থ সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন প্রমুখ। তারা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেন।