আমাদের দেশে ডেঙ্গু ছিল মূলত বর্ষাকালীন রোগ। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশি থাকতো এ রোগের প্রকোপ। চলতি বছর পাল্টে গেছে অতীতের সব হিসাব-নিকাশ। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে এরই মধ্যে গড়েছে রেকর্ড। ডেঙ্গুতে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা হার মানাচ্ছে করোনাকেও। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন এবার ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘ হয়ে শীতকাল পর্যন্ত থাকবে। আর সরকারের জরিপ বলছে, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে গত বছরের দ্বিগুণ। লার্ভা মিলছে ফ্রিজের ট্রের পানি কিংবা প্লেটের পানি ঝরানোর র্যাকের নিচে পর্যন্ত।
গত ২৫ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর দুই সিটিতে মশার ঘনত্ব নিয়ে বর্ষাকালীন জরিপ করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এ জরিপে দেখা যায়, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ (৭৫ শতাংশ) এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে (তেজগাঁও শিল্প এলাকা-বেগুনবাড়ি-তেজকুনিপাড়া)। ৪৯ শতাংশ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে (পল্লবী ও মিরপুরের কিছু অংশ)। দক্ষিণ সিটির ১৯ শতাংশ এলাকায় মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০-এর বেশি। সর্বোচ্চ লার্ভার ঘনত্ব ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে (কাকরাইল-সিদ্ধেশ্বরী-পশ্চিম মালিবাগ) ৭৩ শতাংশ। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে (সেগুনবাগিচা-গুলিস্তান-প্রেস ক্লাব-ঢাকা মেডিকেল এলাকা) ৭০ শতাংশ।
উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ডের এক হাজার ৩৩৫টি বাড়ি এবং দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডের এক হাজার ৮১৫টি বাড়িতে এ জরিপ হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এলাকায় মশার ঘনত্ব নিয়ে প্রতিবছর তিনটি জরিপ করে। জরিপের সময়কে প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত পাঁচ শতাংশ বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া গেলে ওই পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।
জরিপে উঠে আসে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ঢাকার দুই সিটিতে সর্বোচ্চ এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি দেখা গেছে। উত্তর সিটির ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এ এলাকায় এডিসের লার্ভার গড় ঘনত্ব ২৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। দক্ষিণ সিটির ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এই সিটিতে এডিস মশার লার্ভার গড় ঘনত্ব ২৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বর্ষাকালীন জরিপে ঢাকা উত্তর সিটিতে ২১ শতাংশ এবং দক্ষিণে ১৯ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। ২০২০ সালে উত্তরে ১৩ এবং দক্ষিণে ১২ শতাংশ বাড়িতে, ২০২১ সালে উত্তরে ২২ এবং দক্ষিণে ১৭ শতাংশ এবং ২০২২ সালে উত্তরে ১৩ এবং দক্ষিণে ১২ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের দশটি জেলা ও ঢাকার দশটি থানায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছেন। যেগুলোকে ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে ঢাকায় রোগী শনাক্তের হার ৪৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৭৪, বরিশালে ৪ দশমিক ২৬, পটুয়াখালীতে ২ দশমিক ৪৯, লক্ষ্মীপুরে ১ দশমিক ৯৯, পিরোজপুরে ১ দশমিক ৯০, চাঁদপুরে ১ দশমিক ৮৫, মানিকগঞ্জে ১ দশমিক ৮২, কুমিল্লায় ১ দশমিক ৭৫ ও ফরিদপুরে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে রাজধানীর মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকায় রোগী শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ০৮ শতাংশ, সবুজবাগে ১২ দশমিক ৮৭, কদমতলীতে ৮ দশমিক ২৯, মোহাম্মদপুরে ৪ দশমিক ০৩, খিলগাঁওয়ে ৩ দশমিক ৭২, কেরানীগঞ্জে ৩ দশমিক ৭১, উত্তরায় ২ দশমিক ৯২, ধানমন্ডিতে ২ দশমিক ৬৭ এবং পল্লবীতে ২ দশমিক ৬০ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এবার ডেঙ্গু সংক্রমণ সহজে কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই ডেঙ্গুর লার্ভা অনেক বেশি পাওয়া গেছে। ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই) মানদণ্ডে যা অনেক বেশি। খুব তাড়াতাড়ি এই সংক্রমণ কমবে না। শীতকালেও এবার ডেঙ্গু খুব বেশি কমার সম্ভাবনা নেই। তবে বৃষ্টি ও রোগী কমলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। কখন এই সংক্রমণ কমবে তাও বলা যাচ্ছে না।
জরিপকালীন অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, উত্তরের বহুতল ভবনগুলোতে অনেক বেশি লার্ভা আমরা দেখতে পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি পার্কিং লটে জমে থাকা পানিতে আমরা লার্ভা বেশি পেয়েছি। যেসব ভবনের একাধিক মালিক আছেন সেসব ভবনে আরও দেখভাল কম হচ্ছে। ঢাকার বাসা মালিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে একবারেই সচেতনতা দেখছি না। সিটি করপোরেশনের দোষ দিয়ে শুধু বসে থাকলে হবে না। সবাই মিলে একত্রে কাজ না করলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। সিটি করপোরেশনের লোকেরা তো আর বাসার ভিতরে ঢুকতে পারবে না।
এবার ঢাকার বাইরেও সংক্রমণ হচ্ছে, এবছরের তুলনায় পরবর্তী বছরগুলোতে সেসব জায়গায়ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। সাধারণত এডিস মশার ডিম এক বছর পর্যন্ত নষ্ট হয় না। আর ইউনিয়ন পরিষদ বা জেলা পরিষদগুলোর মশা মারার সক্ষমতাও নেই। তাই এখনই এ বিষয় নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বলেন এ কীটতত্ত্ববিদ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) এক সভায় বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে মাইকিং করে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছি। ঢাকা উত্তরের মেয়র যখন যেখানেই যাচ্ছেন ডেঙ্গু সচেতনতায় লিফলেট বিতরণ করছেন।
‘শিক্ষার্থীদের সচেতন করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে বিশেষ একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো স্কুলগুলোতে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আমরা সচেতনতায় র্যালি করছি, বিভিন্ন মিটিং করে পরামর্শ নিচ্ছি। তবুও এই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তবে আমাদের কাজে কোনো ভুল নেই তা বলছি না।’
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘জরিপে ঢাকায় মশার ঘনত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যাও বেড়েছে, যা বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা অন্যের বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারি না। তবে অনেক বাসার ফ্রিজের ট্রেতে জমানো পানিতে লার্ভা পেয়েছি, থালা-বাসন রাখা র্যাকের নিচে পানি ঝরানোর ট্রেতেও লার্ভা পেয়েছি। এছাড়া বাসার এসির জমানো পানিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব জায়গা পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব নিজেদের। সবার সম্পৃক্ততা না থাকলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’
গতানুগতিক ধারায় ওষুধ ব্যবহার ও প্রয়োগ পদ্ধতির কারণে এডিস মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনে মশা দমন পদ্ধতি কোনো কাজেই আসছে না। তাই শুধু কীটনাশক ব্যবহার না করে হলিস্টিক অ্যাপ্রোচের যথাযথ প্রয়োগ অর্থাৎ সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘মশা থেকেই ডেঙ্গু হচ্ছে, এর কামড়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এই মশা নিয়ন্ত্রণে আনতেই প্রধানত উদ্যোগ নিতে হবে। সেই মশা মারার কার্যক্রম তো আমরা দেখছি না। সিটি করপোরেশন মশা মারছে ফগার মেশিন দিয়ে। এই ফগার মেশিন কারা চালাচ্ছে? যাদের একটুও টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। কোনো বিশেষজ্ঞও তাদের গাইড করছে না। তাহলে কীভাবে হবে?’
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৫৭ হাজার ১৭২ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৯ হাজার ৭৬০ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৮৭ হাজার ৪১২ জন ভর্তি হয়েছেন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৬৭ জন।
মশা নিয়ন্ত্রণে আনতেই প্রধানত উদ্যোগ নিতে হবে। সেই মশা মারার কার্যক্রম তো আমরা দেখছি না। সিটি করপোরেশন মশা মারছে ফগার মেশিন দিয়ে। এই ফগার মেশিন কারা চালাচ্ছে? যাদের একটুও টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। কোনো বিশেষজ্ঞও তাদের গাইড করছে না। তাহলে কীভাবে হবে?
অনেক বাসার ফ্রিজের ট্রেতে জমানো পানিতে লার্ভা পেয়েছি, থালা-বাসন রাখা র্যাকের নিচে পানি ঝরানোর ট্রেতেও লার্ভা পেয়েছি। এছাড়া বাসার এসির জমানো পানিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব জায়গা পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব নিজেদের। সবার সম্পৃক্ততা না থাকলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই ডেঙ্গুর লার্ভা অনেক বেশি পাওয়া গেছে। ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই) মানদণ্ডে যা অনেক বেশি। খুব তাড়াতাড়ি এ সংক্রমণ কমবে না। শীতকালেও এবার ডেঙ্গু খুব বেশি কমার সম্ভাবনা নেই।