বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:২৪ অপরাহ্ন




টাকা ছাপানো নিয়ে বিতর্ক কেন?

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ২:০১ pm
money laundering illegal process money generated criminal drug trafficking terrorist funding illegally concealing illicit drug trafficking corruption embezzlement gambling converting legitimate source crime jurisdictions আমদানি ওভার ইনভয়েসিং রপ্তানি আন্ডার-ইনভয়েসিং আমদানি-রপ্তানি অবৈধ জাল অর্থ পাচার জিএফআই মানি লন্ডারিং আর্থিক খাত গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ হুন্ডি অর্থ পাচার সরকার ছিনতাই Per capita income মাথাপিছু আয় Reserves Reserve রিজার্ভ remittance রেমিট্যান্স প্রবাসী আয় ডলার dollar Pagla Mosque পাগলা মসজিদ কোটি টাকা Pagla Mosque পাগলা মসজিদ কোটি টাকা taka taka
file pic

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়িয়েছে অন্যদিকে সরকারের প্রয়োজন মেটাতে টাকা ছাপাচ্ছে, যা বিপরীতমুখী। তবেদ্বিমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান। বলেন, টাকা ছাপানোর যে কথা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। অবশ্য ব্যাংকে নগদ তারল্যের হাহাকার চলছে। অনেক ব্যাংক নগদ টাকার চাপ সামলাতে ধার করে চলছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই টাকা ছাপানোর কাজটি করে। সেগুলো ভল্টে জমা রাখা হয়। ভল্টে থাকা টাকাকে মৃত বা মূল্যহীন বলা হয়। বাজারে এলে তা জীবন পায় বা মূল্যবান হয়। চাহিদা অনুযায়ী এগুলোকে বাজারে ছাড়া হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সম্পদ বা আমানতকারীদের অর্থের মাধ্যমে ছাপানো টাকা বাজারে আসে।

এতে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখে না। তবে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থে বিশেষ তহবিল বা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে ঋণ দিলে সেগুলো হয় ছাপানো টাকা। এসব অর্থ বাজারে এসে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটায়। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক জিডিপি’র আকার বাড়ার সঙ্গে টাকার প্রবাহও বাড়িয়ে থাকে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব উৎস থেকে টাকার জোগান দেয়।

সম্প্রতি এক সেমনিারে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বর্তমানে ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় টাকার সংস্থান করতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়িয়েছে। অন্যদিকে সরকারের প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপাচ্ছে, যেটা বিপরীতমুখী।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে দেশের বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে রাষ্ট্রের কোষাগারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এসব কারণে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিতে হয়েছে।

এ ধরনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান। বলেন, অনেকে একটা কথা বলেন যে টাকা ছাপানো হয়। কিন্তু না জেনে তারা সম্পূর্ণ ভুল বক্তব্য দেন। টাকা ছাপানোর বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের মাধ্যমে বোঝা যায়। হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের আকার গত ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে) হয়েছে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.০৩ শতাংশ কম। অর্থাৎ যত টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে প্রবেশ করেছে, তার চেয়ে কম টাকা বাজারে ছাড়া হয়েছে। কাজটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে। ফলে টাকা ছাপিয়ে বাজারে দেয়া হচ্ছে, এ কথা সঠিক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। তার মানে হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিতে হয়েছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত তা ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। নভেম্বরে তা নামে ১ লাখ ৮ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকায়। গত ২০২৩ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে ছাপানো টাকায় নেয়া ঋণের মধ্যে সরকার ফেরত দিয়েছে ২২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর বাইরে সরকার ২৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ছেড়ে ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এই টাকাও বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এটিও টাকা ছাপানোর মতোই।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে সবচেয়ে বেশি টাকার জোগান আসে সরকারকে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে যে ঋণ দেয়, এর প্রায় পুরোটাকেই বলা হয় ছাপানো টাকা। এসব টাকা বাজারে এলে মুদ্রার সরবরাহ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতে চাহিদা বাড়ে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়।

এদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়বে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া আগে ছাড়া টাকার কিছু অংশ পর্যায়ক্রমে বাজার থেকে তুলে নেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারি ট্রেজারি বিলবন্ডে বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। একই অর্থবছর সরকারি ট্রেজারি বিলবন্ডের ১ লাখ ৪৬৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বিনিয়োগের ৭৭ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। মূলত সরকারের ঋণ চাহিদা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মেটাতে পারেনি। কারণ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার কারণে টাকা বাজার থেকে উঠে গেছে। তাই বিলবন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। গেল অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে, তার পুরোটাই ছাপিয়ে দেয়া হয়।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, টাকা না ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজারে অর্থ প্রবাহ রাখা যেতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সক্ষমতা হারানোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ধার দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকসহ সব ব্যাংকেও আর হাইপাওয়ারড্ মানি দেয়া যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ইতিমধ্যে হাইপাওয়ারড্ মানি অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থের প্রবাহ কিছুটা সংকুচিত করতে আটসাঁটো মূদ্রানীতির ভঙ্গিতে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক মাসে ছাপানো টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। কারণ, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে মানুষের হাতে নগদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের ভল্টে থাকা টাকার পরিমাণ কমে গেছে। ডিসেম্বরে ভল্টে ছিল (কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকে) ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা রয়েছে মানুষের হাতে বা সিন্দুকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ডিসেম্বরে ২৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৯২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।

গত নভেম্বরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ভল্টে ছিল ২৬ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৬৫ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৯১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে বা সিন্দুকে। তবে রেকর্ড পরিমাণ টাকা ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে ছিল গত জুন মাসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে মোট ছাপানো নোটের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৯২ থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। সাধারণত কোরবানির ঈদের সময় মানুষের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকে।

চাইলে কি নোট ছাপানো যায়?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৪ঠা মার্চ দেশের নিজস্ব কাগুজে মুদ্রা চালু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ৬ মাস না যেতেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে কাগুজে নোট। সে তুলনায় খরচ বেশি হলেও ধাতব কয়েনের স্থায়িত্বও অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছর শুধু নতুন নোট ছাপাতে সরকারের খরচ হয় ৪ থেকে ৫০০ কোটি টাকা।

মূলত, নষ্ট হয়ে যাওয়া টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই পরে নতুন নোট আনা হয়। অর্থাৎ নতুন নোট ছাপানো হয়।

বর্তমান বিশ্বে টাকা ছাপানোর কারখানা রয়েছে মোট ৬৫টি। বাংলাদেশের কারখানাটির নাম টাকশাল। টাকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগে অন্য দেশ থেকে ছাপানো হতো। এর মধ্যে রয়েছে- সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইংল্যান্ড। টাকশালের টাকা ছাপানোর ধাপগুলো খুবই গোপনীয়। সেখানে প্রায় ১২টি ধাপ পেরোতে হয় টাকা তৈরির জন্য। কারখানার অভ্যন্তরে সব কর্মচারীর মোবাইল ফোন কিংবা যেকোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহারও নিষিদ্ধ।

পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাতে পারে না। এতে কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। তবে সরকার যদি চায় সহায়তা নিতে, সেক্ষেত্রে সরকারের অনুরোধে একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলে অনেক প্রকল্প-সাপোর্ট মেকানিজম করে যেটার মাধ্যমে টাকা ছাপানো হয়। এককভাবে কিছু করা যায় না। বোর্ড আছে, সে বোর্ডের অনুমোদন লাগবে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD