০১. মুসলিম হওয়া: মুসলিমের উপর সিয়াম ফরজ: যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, সেই মুসলিম ব্যক্তির উপর সিয়াম ফরজ। মুসলিম হল সেই ব্যক্তি আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুকরণে এবং অনুসরণে জীবন অতিবাহিত করার ঘোষণা দেয়। বলে, আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ। সে ব্যক্তি মুসলিম।
০২. সিয়াম অস্বীকারকারী কাফির: কাফিরের উপর সিয়াম ফরজ নয়: যেহেতু আল্লাহ সিয়ামকে মুসলিমদের জন্য ফরজ করেছেন এবং যেহেতু মুহাম্মাদ (ﷺ) সিয়ামকে ফরজ হিসেবে ইসলামী শারি’য়াতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেহেতু সকল মুসলিমের জন্য সিয়াম পালন ফরজ ইবাদাত এবং সকল মুসলিম তা মেনে চলতে বাধ্য। কোন মুসলিম সিয়ামের বাধ্য-বাধকতাকে অস্বীকার করলে সে কাফির বলে বিবেচিত হবে।
০৩. বালিগ-প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া: বালিগের উপর সিয়াম ফরজ: (বালিগের জন্য আলামত ও বয়স) – কোনো ছেলে বা মেয়ের মধ্যে বালিগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়ার নির্দিষ্ট আলামত পাওয়া গেলে এবং নির্দিষ্ট বয়সসীমায় পৌঁছলেই তাকে বালিগ বলে গণ্য করা হবে এবং তাদের উপর সিয়াম ফরজ বলে কার্যকর হবে। বয়স এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সে দায়িত্ব নেয়ার মত সক্ষম হয়েছে এবং সাধারণভাবে ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের বালিগ হওয়ার আলামত প্রকাশিত হলে তার উপর ইসলামী শরিয়তের সকল বিধি-বিধান কার্যকর হবে।
০৪. ছেলে-মেয়েদের বালিগ হওয়ার আলামত: ছেলেদের কন্ঠস্বর পরিবর্তন হওয়া, দাড়ি-গোঁফ উঠা, স্বপ্নদোষ হওয়া, বির্যপাত হওয়া ইত্যাদি। মেয়েদের ক্ষেত্রে হায়েজ (মাসিক ঋতুস্রাব) শুরু হওয়া; গর্ভধারণ করা এবং স্তন বড় হওয়া ইত্যাদি বালিগ হওয়ার আলামত বা চিহ্ন। বালিগ হওয়ার উপরোক্ত নির্দিষ্ট আলামত যদি কোনো ছেলে বা মেয়ের মধ্যে পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে উভয়ের বয়স ধর্তব্য; যখন কারো বয়স হিজরী বর্ষ হিসাবে ১৫ বছর পূর্ণ হবে, তখন প্রত্যেককে বালিগ হিসেবে গণ্য করা হবে।
০৫. ইসলাম ১৫ বছর বয়সে বালিগ হওয়ার সনদপত্র দেয়: নাফে (রাহি.) আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে সবার সামনে পেশ করেন, তখন আমি ১৪ বছরের বালক। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে যুদ্ধে গমনের অনুমতি দেননি। পরের বছর আমি খন্দকের যুদ্ধে নিজেকে যুদ্ধের জন্য পেশ করি, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে যুদ্ধের জন্য অনুমতি দেন। তখন আমি ১৫ বছরের যুবক (বুখারি-ইফাবা-হা-২৪৮৮)।
০৬. মুসলিম সেনাবাহিনীতের যোগদানের বয়সের যোগ্যতা: নাফে (রাহি.) বলেন, আমি খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কাছে গিয়ে এ হাদিস শুনালাম। তিনি বলেন, এটাই হচ্ছে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়সের সীমারেখা। তারপর তিনি তাঁর গভর্নরদের লিখিত নির্দেশ পাঠালেন যে, সেনাবাহিনীতে যাদের বয়স ১৫ বছর হয়েছে, তাদের জন্য যেন ভাতা নির্দিষ্ট করা হয়। (বুখারি-ইফাবা-হা-২৪৮৮; আন্তর্জাতিক-হা-২৬৬৪; মুসলিম-হা-১৮৬৮)।
০৭. বুদ্ধিমান হওয়া এবং সিয়াম সম্পর্কে জ্ঞান থাকা ব্যক্তির উপর সিয়াম ফরজ:
এক. সাধারণভাবে এটি প্রমাণিত যে, সাধারণ মানের বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে সক্ষম; তারা ইসলামী শরি’য়াতে বিভিন্ন ইবাদাতসহ সিয়ামের হুকুম-আহকাম পালনে সক্ষম। সাধারণ ভাবে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সিয়ামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানে এবং সিয়ামের বিভিন্ন মাসলা-মাসাইল জানানো হলে তারা তা মেনে চলতে সক্ষম। তাদের উপর সিয়াম ফরজ।
দুই. বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা পরিবার, প্রতিবেশী এবং সমাজের বিভিন্ন লোকদের সাথে সিয়াম জনিত বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করতে সক্ষম। এমন সব সাধারণ বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের উপর সিয়াম ফরজ। তারা জানে কখন এবং কি কিভাবে সিয়ামের নিয়ত করতে হয়; তারা জানে সিয়াম ভঙ্গের কারণ; তারা জানে কিভাবে অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়; তারা জানে কখন সাহরী খেতে হয় এবং কখন ইফতারের সময়। এই সব সাধারণ মানের বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের উপর সিয়াম ফরজ।
তিন. বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা জানে কখন ফিতরা (যাকাতুল ফিতর) আদায় করতে হয় এবং তারা জানে কখন ঈদুল ফিতরের সালাত আদায় করা হয়। পক্ষান্তরে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, উন্মাদ এবং পাগলের পক্ষে বিভিন্ন ইবাদাতসহ সিয়াম জনিত হুকুম-আহকাম এবং মাসলা-মাসাইল জানা এবং তা মেনে চলা কোনভাবেই সম্ভব নয়; আর, সেজন্য তাদের উপর সিয়াম শর্ত নয়।
০৮. যার মধ্যে শারিরীক ও মানসিক সুস্থতা বিরাজ করছে তার উপর সিয়াম ফরজ:
এক. একজন শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির জন্য সিয়াম পালন ফরজ। সুস্থ ব্যক্তি আযীমতের উপর সিয়াম পালন করবেন। কারণ সুস্থ অবস্থায় একজন ব্যক্তি কোনরূপ শারিরীক অসুবিধা ছাড়ায় সিয়াম পালন করতে সক্ষম।
দুই. অন্যদিকে অসুস্থ্ ব্যক্তি সিয়াম পালনে রুকসাত গ্রহণ করবে। অসুস্থ্ ব্যক্তির রোগ যদি মারাত্মক হয় এবং রোগের কারণে সে যদি সিয়াম রাখতে অসক্ষম হয়, তবে তার জন্য সিয়াম পালন শর্ত নয়। অসুখ থেকে সুস্থ হওয়ার পর সে তার কাযা সিয়াম আদায় করবে। অসুস্থতা জনিত কারণে যে কয়টি সিয়াম ছেড়ে দিয়েছে, তার কাযা সিয়াম রমযান মাসের পরে অন্য কোন মাসে আদায় করবে; তবে কাযা সিয়াম তাড়াতাড়ি পালন করা উত্তম। মনে রাখবেন, মানুষের জীবন ও মৃত্যু নির্ধারিত।
০৯. মুক্বিম হওয়া: নিজ বাসস্থানে অবস্থানরত ব্যক্তির উপর সিয়াম ফরজ: যখন কোন ব্যক্তি নিজ বাড়িতে এবং নিজ শহরে অবস্থান করেন, তখন তিনি মুক্বিম হিসেবে বিবেচিত। সাধারণভাবে মুক্বিম ব্যক্তির উপর সিয়াম ফরজ। মুক্বিম ব্যক্তি আযীমতের উপর সিয়াম পালন করবেন। কারণ মুক্বিম অবস্থায় একজন ব্যক্তি কোনরূপ অসুবিধা ছাড়ায় সিয়াম পালন করতে সক্ষম।
১০. মুসাফিরের জন্য সিয়ামে পালনে রুকসাত রয়েছে: মুসাফির ব্যক্তি সিয়াম পালনে রুকসাত গ্রহণ করতে পারে। মুসাফির তার সফরের অবস্থা এবং ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে সে ইচ্ছা করলে সিয়াম রাখতে পারে (যদি সফর কষ্টমুক্ত হয়), আবার সে ইচ্ছা করলে সিয়াম না রাখার অবকাশ গ্রহণ করবে (যদি সফর কষ্টকর হয়)। সফরকালীন সময়ে যে কয়টি সিয়াম ছেড়ে দিয়েছে, তার কাযা সিয়াম রমযান মাসের পরে অন্য কোন মাসে আদায় করবে; তবে কাযা সিয়াম তাড়াতাড়ি পালন করা উত্তম। মনে রাখবেন, মানুষের জীবন ও মৃত্যু নির্ধারিত।
১১. মহিলাদের হায়েযমুক্ত এবং নেফাসমুক্ত হওয়া শর্ত: যে মহিলা হায়েযমুক্ত এবং যে মহিলা নেফাসমুক্ত তাদের উপর সিয়াম ফরজ। মহিলাদের জন্য সিয়াম পালন করার দুটি প্রধান শর্ত হল: মহিলাদের অবশ্যই হায়েসমুক্ত অবস্থা হতে হবে (ঋতুবতী-মাসিক থেকে মুক্ত পবিত্র থাকতে হবে) এবং নেফাস মুক্ত হতে হবে (শিশু জন্ম দেওয়ার পরে পবিত্র অবস্থা অর্জন করতে হবে; সাধারণত এই সময়কাল ছয় সপ্তাহ)।
এক. আল্লাহ অতিশয় মেহেরবান: মহিলাদের হায়েয ও নেফাস অবস্থায় সিয়াম এবং সালাত আদায় নিষেধ (হারাম) করা হয়েছে। এটি মহিলাদের জন্য একটি কষ্টকর অবস্থা। রমযান মাসের পরে হায়েস-নেফাস মুক্ত অবস্থায় সিয়ামের কাযা আদায় করবে, কিন্তু সালাতের কাযা আদায় করার আবশ্যকতা নেই। কারণ হায়েস-নিফাস এর কারণে সালাত সম্পূর্ণরূপে মাফ। আল্লাহ মহিলাদের জন্য অতিশয় মেহেরবান; আল-হামদু লিল্লাহ।
দুই. সিয়াম অবস্থায় মাসিক (ঋতুস্রাব) হলে সিয়াম বাতিল: সিয়াম পালনকারী নারীর যদি সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বেও মাসিক (ঋতুস্রাব) শুরু হয়, তাহলে তার ওই দিনের সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। তবে তা কাযা করতে হবে। তবে নফল সিয়াম হলে এর কাযা করাও নফল হবে। আর যদি কোনো নারী রমযানের দিনের মধ্যভাগে মাসিক-ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে দিনের শুরুতে সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে ওই দিনের বাকী অংশেও সিয়াম পালন সহীহ হবে না। তবে প্রশ্ন হলো, দিনের অবশিষ্টাংশ সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে কি না; সিয়াম পালনকারীদের সম্মানে পানাহার থেকে বিরত থাকতে পারে।
তিন. রাতে মাসিক (ঋতুস্রাব) থেকে মুক্ত হলে সিয়াম ফরজ: আর যদি রমযানের রাতে সুবহে সাদিক উদয়ের সামান্য পূর্বেও কোনো নারী ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে তার ওপর সিয়াম পালন ফরজ হবে। কেননা সে সিয়াম পালনে সক্ষমদের অন্তর্ভুক্ত, সিয়াম পালনে তার তো এখন কোনো বাধা নেই। তাই তার ওপর সিয়াম পালন ফরজ। যদি সে সুবহে সাদিকের পর গোসল করে তবুও সিয়াম শুদ্ধ হবে। উল্লেখ্য যে, আর নিফাসযুক্ত মহিলাদের বিধান হায়েয অবস্থতার মহিলাদের বিধানের মতোই।
চার. ফজর সালাতের পূর্বে পবিত্রতা অর্জন এবং সিয়াম পালন: যদি কোন অপবিত্র ব্যক্তি সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পর গোসল করে, তবে তার সিয়াম শুদ্ধ হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্ত্রী-মিলন জনিত (জুনুবী) অবস্থায় ফজরের সময় হয়ে যেত; এরপর তিনি ফরজ গোসল করতেন, ফজরের সালাত আদায় করতেন এবং রমযানের সিয়াম পালন করতেন (বুখারী-ইফাবা-হা-১৮০৩; সিয়াম অধ্যায়)।
আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন। (মূসা: ১৪-০৩-২৪)।