মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৬:২০ পূর্বাহ্ন




ডলারের সঙ্গে টাকার মান সমন্বয় করলে অর্থনীতিতে চাপ কম হতো: মসিউর রহমান

আউটলুকবাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ৭:০৭ pm
Adviser Prime Minister Sheikh Hasina Mashiur Rahman Dr. Moshiur Rahman মসিউর রহমান প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা
file pic

টাকার মান দীর্ঘকাল ধরে না রেখে সময়ে সময়ে ডলারের সঙ্গে সমন্বয় করলে অর্থনীতির উপর চাপ একবারে পড়ত না। চাপটি ধীরে ধীরে আসলে তা সহনশীল হতো বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেছেন, এটি করলে টাকার মান কমে যাওয়ার ধাক্কাটা একবারে ব্যবসায়ীদের উপর একবারে আসতো না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ(পিআরআই) আয়োজিত ‘‘বাংলাদেশ’স ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন; ইমপেরাটিভস অ্যান্ড এ রোডম্যাপ’’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।

দীর্ঘ কয়েক বছর ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার একই জায়গায় ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২০ সালেও ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান ৮৪ টাকার ঘরেই ছিল। কভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ শেষে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গেলে বাংলাদেশে হঠাৎ করেই আমদানি চাহিদা বেড়ে যায়।

বছরটির শেষের দিকে থাকা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমতে থাকে আমদানি চাপে। অর্থনীতিবিদরা আমদানি চাপ বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মন্তব্য করে অর্থপাচার হচ্ছে বলে অভিযোগও করে আসছিলেন।

তিন বছরের ব্যবধানে সেই রিজার্ভ এখন ২৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।

রিজার্ভের এ অঙ্ক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ) এর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। ঋণ চুক্তির শর্ত মানলে নিট রিজার্ভ আরো কম হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীট রিজার্ভ আইএমএফকে জানালেও তা প্রকাশ করছে না।

গত তিন বছরে ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকা মান হারিয়েছে ২৫ দশমিক ৬০ টাকা বা ৩০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

টাকার এই মান হারানোতে উদ্যোক্তরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দাবি করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘‘টাকার মান পড়ে যাওয়ায় গত চার বছরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমাদের এ ক্ষতি কিভাবে পুশিয়ে দেওয়া যায় তা সরকারকে ভাবা দরকার।’’

তিনি বলেন, ‘‘ডলার ক্রাইসিস(সংকট) এখনো কাটেনি। ব্যাংক থেকে ১১৫-১৬ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে আমদানি করতে গেলে। কখনো কখনো তা আরো বেড়ে যায়।’’

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাবি করেন ব্যবসায়ীদের এ নেতা।

টাকার মান সমন্বয় করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন দায়িত্ব দিয়েছে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এর উপর।

সংগঠন দুটির উপর দায়িত্ব দেয়ার পর রেমিটেন্সে ডলারের দাম ১১৫ টাকায় উঠেছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। ব্যাংকগুলো ডলারের সংকটের সময়ে গত নভেম্বরে ১২২-১২৪ টাকা ধরেও কিনেছিল রেমিটেন্স।

নিয়ন্ত্রণ করায় ডলারের ঘোষিত দর গত কয়েক মাস ধরেই ১১০ টাকা আর খোলা বাজারে তা ১১৮ টাকা। ব্যাংকগুলো আমদানি পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১১৫-১৬ টাকা করে নিচ্ছে।

মসিউর রহমান বলেন, ‘‘টাকার মান এক জায়গায় ধরে না রেখে ডলারের সঙ্গে ধীরে ধীরে সমন্বয় করতে দিলে ব্যবসায়ীরা আগাম ধারনা পেতেন। তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সহজ হতো। সেটি না করায় গত কয়েক বছরে চাপটি একসঙেগ বেড়েছে।’’

তিনি বলেন, ‘‘পর্যায়ক্রমে দর সমন্বয় করলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতির উপর তা সহনশীল আকারে পড়তো। এতোটা চাপে পড়তেন না ব্যাবসায়ীরা।’’

পৃথিবীর অনেক দেশ এখনো ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা প্রয়োজনের চেয়েও অবমূল্যায়ণ করে রেখেছে। এতে রপ্তানি খাত সম্প্রসারিত হয়।

বাংলাদেশও সেই নীতিতে যেতে পারতো বলে মন্তব্য করে মসিউর রহমান বলেন, ‘‘স্থানীয় মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমিয়ে রাখা ভালো।’’

ব্যাংক গত বছরের জুলাই মাসে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। স্মার্ট রেটের সঙ্গে তা প্রতি মাসেই সমন্বয় করায় ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন ১৪ শতাংশের ঘরে।

সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসা খরচ বাড়ছে এফবিসিসিআই সভাপতির দাবির উত্তরে মসিউর রহমান বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংক ঋণের সুদহার র্নিধারণের বিষয়ে বলা আছে, সুদহার হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট অনুযায়ী। সেখানে সুদের হর নির্ধারণ করার কথা বলা হয়নি।’’

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বা নীতি সুদহার হচ্ছে আট শতাংশ। কিন্তু এই নীতি সুদহার অনুযায়ী সুদহার র্নিধারণ করা হচ্ছে না।

ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের উপর ভর করে ‘স্মাট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল)’ রেট প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্মার্ট রেটের সঙ্গে আরো মার্জিন যোগ করে গ্রাহক পর্যায়ে বর্তমান সুদহার দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশে।

মূল প্রবন্ধে জিডিপি(মোট দেশজ উৎপাদন) এর তুলনায় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে পিআরাই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘রাজস্ব আদায়ের এমন সক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশ ম্যধম আয়ের দেশে উপনীত হতে যাচ্ছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আগামীতে দেশি-বিদেশি ঋণ সুদ পারিশোধ, মজুরি বৃদ্ধিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ, ভর্তুকি ও পেনশন খাতে খরচ বাড়বে সরকারের। এই বাড়তি খরচ মেটাতে রাজস্ব আদায় না বাড়ালে অর্থনীতির ঝুঁকিটা বাড়বে।’’

কর কাঠামো ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) এর সংস্কার, আর্থিক খাতে দেওয়া আইএমএফ এর সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলে আগামী চার বছরে অতিরিক্ত ৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।

এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়ন না করলে ২০৪১ সাল শেষে ৫০ লাখ কোটি টাকার রজস্ব ক্ষতি হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতীশীলতা ও দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে রাজস্ব আদায় বৃদিধ অতি জরুরি।’’

কর ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে গবেষণার তথ্য দেন তিনি।

শুধু ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করলেই রাজস্ব আদায় বাড়ানো যাবে না বলে মন্তব্য করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহম্মব্দ আব্দুল মজিদ।

তিনি বলেন, ‘‘রজস্ব আদায় বাড়াতে কর ছাড় কমানোসহ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন যোগ করতে হবে। যাতে করছাড় কমানো যায়।’’

বর্তমানে উদ্যোক্তারা বিভিন্ন খাতে ১২০ ধরনের করছাড় সুবিধা ভোগ করছেন। গত ২৫ বছর ধরে কিছু খাত এই ছাড় সুবিধা ভোগ করছে। তাদের ছাড় কমিয়ে নিজস্ব সক্ষমতার উপর দাঁড় করানোর সুপারিশ করে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘‘কর ছাড় দেওয়ার সুযোগগুলো যৌক্তিকীকরণের সময় হয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের কর ছাড় না নেওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।’’

ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পেয়ে ব্যবসার খরচ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারের বন্ড বাজারটি উন্নয়নের সময় হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের বদলে পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেন। তাহলে ব্যাংকমুখী সুদ থেকে বাঁচতে পারবেন। ব্যাংকের উপর থেকেও তারল্য চাপ কমে আসবে। অর্থনীতির উন্নয়নে পুঁজিবাজারমূখী হতে হবে।’’

বাণিজ্য শুল্কের উপর নির্ভরতা কমিয়ে এনে প্রত্যক্ষ কর আহরণে জোর দেয়ার পরামর্শ দেন পিআরআই চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার।

সেমিনারে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, প্রতিবছর একটি করে খাতকে নীতি সুবিধার জন্য বাছাই করে এনবিআর। নীতি সুবিধা দেওয়ার কারণেই এখন সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। আমরা চাই আমদানি নির্ভরতা কমে দেশিয় শিল্প খাত বিকশিত হোক। মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে বিশাল বাজার রয়েছে তার সুবিধা ভোগ করছে বিদেশি অর্থনীতি। দেশিয় উদ্যোক্তদের মধ্যবিত্তের সেই চাহিদা পূরণ করতে যে সুবিধা দেয়া প্রয়োজন তা এনবিআর দিবে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD