বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫৫ অপরাহ্ন




‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে ছিল চূড়ান্ত বিপ্লবের ডাক

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ২:০০ pm
QUOTA REFORM কোটা আন্দোলন blockade shabag Shahbagh Shahbag Blockade শাহবাগ অবরোধ প্রতিবন্ধ আটক কারাগার আবরণ পরিবেষ্টন ঘেরাও shahbagh_quota_protest shahbagh quota protest shahbagh_quota_protest shahbagh quota protest2
file pic

১৪ জুলাই রাত ১০টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীম ‍উদদীন হলের প্রতিটি রুম থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। উত্তর পাশের ইউনিট থেকে শিক্ষার্থীরা সমস্বরে প্রশ্ন তোলেন ‘তুমি কে আমি কে’। দক্ষিণ পাশের ইউনিট থেকে সমস্বরে উত্তর ভেসে আসে ‘রাজাকার রাজাকার’। একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ধ্বনিত হতে থাকে ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার।’

কিছুক্ষণের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে সেই ভিডিও। রাত সাড়ে ১১টায় হলগুলো থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন রাজু ভাস্কর্যে। রাত ১০টার পর নারী শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হওয়া নিষেধ। কিন্তু যাদের ভেতর লুকিয়ে আছে বিপ্লবের বিজ, তাদেরকে আজ বাধা দেবে কোন সে রুদ্র। হলগুলোর তালা ভেঙে একই স্লোগানে দলে দলে বেড়িয়ে আসেন নারী শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।

উল্লেখ্য, এইদিন দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে তিরস্কার করেন তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরদিন ১৫ জুলাই ‘স্বঘোষিত রাজাকার’ অপবাদ দিয়ে প্রতিবাদি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও তার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একই সাথে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী স্লোগানের প্রসঙ্গ আড়াল করে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন তিনি ও তার অনুসারীরা। এমনকি ‘রাজাকার স্লোগানধারীদের’ দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকিও দেন তারা। তাদের দলে যোগ দিয়ে কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘স্বঘোষিত রাজাকার’দের ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনো প্রবেশ না করার ঘোষণা দেন। এইদিন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদি সমাবেশে সশস্ত্র ভারাটিয়া বাহিনী নিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগ। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে অতীতের ন্যায় এই হামলায় পিছু হটেননি শিক্ষার্থীরা। বরং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁনোর প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হন তারা।

১৬ জুলাই মঙ্গলবার সরাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের ডাক দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই দিন বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬ জন প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বুকে পুলিশের গুলি চালানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। দুই হাত প্রসারিত করে বুক উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের বুকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠে সারা দেশ। পরিস্থিতি এমন একটি সমীকরণে গিয়ে পৌঁছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য বাঁচা-মরার লড়াইয়ে পরিণত হয়। বাঁচার জন্য শিক্ষার্থীদের সামনে একটি মাত্র করণীয় ছিল- শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের দেশ থেকে বিতারিত করা।

ঠিক সেইদিন রাতেই শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে তাড়ানোর প্রাথমিক কাজটি শুরু করে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেত্রীদের মধ্যরাতে হল থেকে বের করে দেন তারা। পরদিন ১৭ জুলাই সকাল ৮টার মধ্যে ছাত্রলীগ মুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল। সেইদিন থেকেই স্বাধীনতার পদধ্বনি শুনতে পান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সরকারের হস্তক্ষেপে ওইদিন সন্ধ্যার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ। হল বন্ধের বিরুদ্ধেও চলতে থাকে প্রতিবাদ। যুক্ত নতুন নতুন স্লোগান- ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’; ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’।

সরকার হটানোর চূড়ান্ত আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৮ জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। স্বৈরাচারী হাসিনার দুঃশাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্খা যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালায় মতো তাড়িয়ে বেড়ায় আন্দোলনকারীদের। রাজপথে বেরিয়ে আসেন সারাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সহ সব ধরনের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন চলতে থাকে পরদিন শুক্রবারও। আন্দোলন চলাকালে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এছাড়া আন্দোলন দমনের জন্য হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের মিছিল ও সমাবেশে গোলাবারুদ বর্ষণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুই দিনে নিহত হন দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। এছাড়াও প্রাণ দেন আন্দোলনে অংশ নেয়া অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ।

১৮ জুলাই থেকে টানা পাঁচ দিন দেশের সর্বত্র সবধরনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। বন্ধ হয়ে যায় তথ্য সরবরাহ এবং সব ধরনের অনলাইন সেবা। ১৯ জুলাই রাত থেকে জারি করা হয় অনির্দিষ্টকালের কারফিউ। বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব ধরনের অফিস-আদালত। বিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা।

২২ জুলাই। সরকারি চাকরিতে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী কোটা সংস্কারের ঘোষণা দেন আদালত। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সারাদেশে চারদিক থেকে তখন শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো গণহত্যার বিচারের দাবি উঠেছে। যুক্ত হয় নতুন স্লোগান, ‘তবে তাই হোক বেশ, জনগণই দেখে নিক এর শেষ।’

দিশেহারা হয়ে সরকার সারাদেশে শুরু করে আটক ও গুম অভিযান। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পাশাপাশি এই আটক ও গুম অভিযানের শিকার ছিলেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আওয়াজ তোলেন হাতে গোনা কিছু সংখ্যক ছাত্রবান্ধব শিক্ষক, পেশাজীবী ও সুশিল সমাজের সদস্য।

২৮ জুলাই কেন্দ্রীয় ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দিতে বাধ্য করেন। কিন্তু সরকারের এই পরিকল্পনা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। বাহিরে থাকা সমন্বয়কেরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরমধ্যে শেখ হাসিনা একাধিকবার আলোচনায় বসতে চাইলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দেয়ালচিত্র এবং প্লেকার্ডে তার উদ্দেশে বার্তা ছিল- ‘নাটক কম করো পিও’।

১ আগস্ট আটক সমন্বয়কদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। এই দিন চলে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি। পরদিন শুক্রবার ঘোষণা করা হয় ‘প্রার্থণা ও গণমিছিল’ কর্মসূচি। অন্যদিকে বাড়তে থাকে সরকারের দমন পীড়ন এবং নিহতের সংখ্যা। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে সৃষ্ট জনসমূদ্র থেকে সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। একই সাথে ডাক দেয়া হয় অনির্দিষ্টকালের অসহযোগ আন্দোলন। ৬ আগস্ট ঘোষণা করা হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। এ সময় স্লোগানের তালিকায় যুক্ত হয়- ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়।’

৪ আগস্ট সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। একদিনেই পুশিল ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন। এছাড়াও প্রাণ হারান অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এমন পরিস্থিতিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট ঘোষণা করা হয়।

৫ আগস্ট সোমবার। কারফিউ চলছে। সকাল থেকে পুরো শহর থমথমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনকারীদের খণ্ডখণ্ড মিছিলে পুলিশের নির্বিচার গুলি করছে তখনও। ঢাকার দুই প্রান্ত- যাত্রাবাড়ি ও উত্তরা এলাকা থেকে লক্ষাধিক মানুষের দুটি মিছিল তখন এগিয়ে আসছে শাহবাগের দিকে। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সারাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ। সাধারণ মানুষের মাঝে তখন চরম ‍উৎকণ্ঠা। মূলত হাসিনা তখন পালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওইদিকে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল গণভবন দখলের লক্ষ্যে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পার হচ্ছে। দুপুর ১টা ৩০ মিনিট। ইন্টারনেট সংযোগ ফিরে আসতেই জানা গেল পদত্যাগ করে গণভবন থেকে পালিয়েছে হাসিনা। বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল তখন গণভবনের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকছে। মিছিলে ধ্বনিত হচ্ছে ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার’; ‘কে বলেছে কে বলেছে- স্বৈরাচার স্বৈরাচার’।

লেখক: আতিকুর রহমান (নয়ন), গণমাধ্যম গবেষক ও উন্নয়নকর্মী




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD