রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আসাদুজ্জামান তাঁকে দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেন। পরীক্ষা নিরীক্ষায় তাঁর হৃৎপিণ্ডে দুটি ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা রিং পরানোর পরামর্শ দেন। জটিলতা তৈরি হয় তখনই। কারণ, এই হাসপাতালে রিং পরাতে অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই মাস। এর আগে ‘সিরিয়াল’ নেই। আর্থিক সামর্থ্য থাকলে বেসরকারি হাসপাতালে রিং পরানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে দুইটা রিং পরাতে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হবে। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বাবাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রেখে সিরিয়াল আসার অপেক্ষা করছি।’
একই অবস্থা চামেলি দাসের। হার্টের সমস্যা নিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি। চামেলি বলেন, ‘এনজিওগ্রাম করানোর পর হার্টে ৭৪ শতাংশ ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসক জরুরি রিং পরানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে।’ প্রচণ্ড ব্যথা সইতে না পেরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে রিং পরিয়েছেন এই নারী। শনিবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। বারান্দা, করিডোর থেকে শুরু করে সিঁড়ি পর্যন্ত রোগীর সারি। মেঝেতে অতিরিক্ত শয্যা দেওয়ার পরও ভিড় সামলাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। রোগীরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিছানা করে শুয়ে আছেন। দ্রুত সেবা দিয়ে তাদের ছাড়পত্রও দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানায়, ৭০০ শয্যার এ হাসপাতালে সব সময় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার রোগী আসেন। দৈনিক ১৩০ জনের এনজিওগ্রাম এবং ১০০ রোগীর হার্টে রিং পরানো হয়। এ ছাড়া শতাধিক অস্ত্রোপচার হয়। অতিরিক্ত রোগী থাকার কারণে সেবার মান নিশ্চিত করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এর পরও দরিদ্র মানুষের একমাত্র ভরসা এই হাসপাতাল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে হার্টে রিং পরানো ও বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। তাই অধিকাংশ রোগী বেসরকারি ল্যাবএইড, গ্রিনলাইফ, পুপলার ও স্কয়ার হাসপাতালে বাড়তি টাকায় সেবা নিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করাতে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হলেও বেসরকারি হাসপাতাল নিচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। হার্টের রিং পরাতে সরকারি হাসপাতালে সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হলেও বেসরকারিতে খরচ হচ্ছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ব্যয় বহন করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
একাধিক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জানান, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশে হৃদরোগের জন্য চালু সেবাকেন্দ্র চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে, প্রতিনিয়ত রোগী বাড়ছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ থাকলেও মফস্বল শহরে নেই। দক্ষ চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে দেশের জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্তের সেবা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে সরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের সেবা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘হৃদয়ের যত্ন হোক সর্বজনীন’। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মিলে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন ১৯৯৯ সালে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় হৃদরোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০০ সাল থেকে দিনটি পালন হচ্ছে।
হৃদরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যাথেটেরাইজেশন ল্যাবরেটরি বা ক্যাথ ল্যাব অত্যন্ত জরুরি। এ ল্যাবে এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি, পেসমেকার বা আইসিডি ইমপ্লান্টেশনসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৮৭টি ক্যাথ ল্যাব রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে স্থাপন করা হয়েছে ৫৮টি। জনবলের অভাবে সারাদেশে পড়ে আছে আটটি ক্যাথ ল্যাব।
ঢাকায়ও অনেক হাসপাতালে ক্যাথ ল্যাবে যন্ত্র অচল। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে অকেজো হয়ে পড়ে আছে তিনটি মেশিন। এ ছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিগ্রাফিকের সরবরাহ করা আটটি ক্যাথ ল্যাব মেশিন অকেজো।
শুধু অপ্রতুল যন্ত্র নয়, হৃদরোগে আক্রান্তদের কার্যকর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামোও নেই দেশে। তাই প্রতিবছর যত সংখ্যক হার্টের সার্জারি হওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪২টি কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ৩২টিতে কার্ডিওভাসকুলার সার্জারির ব্যবস্থা আছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার সার্জারির প্রয়োজন হয়। কিন্তু করা হয় ১০-১২ হাজার। ফলে অনেক রোগীই চিকিৎসা পান না।
দেশে কতজন হৃদরোগে আক্রান্ত ও বছরে কতজনের এই রোগে মৃত্যু হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে মোট মৃত্যুর সর্বোচ্চ ১৯.১৭ শতাংশ হয়েছে হৃদরোগে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘হার্ট অ্যাটাকের দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হয়। এ সময়ের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এনজিওপ্লাস্টি করে চিকিৎসা দেওয়া হলে ক্ষতি কম হয়। সেটি সম্ভব না হলে রক্ত তরল করার ইনজেকশন দিয়ে অন্য কোথাও রেফার করতে হয়। এই ব্যবস্থা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে নেই।’
এই বিশেষজ্ঞের মতে, হৃদরোগী বাড়ার পেছনে তামাকের ব্যবহার, স্থূলতা, ট্রান্স ফ্যাট, লবণ বেশি খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং বায়ুদূষণ দায়ী। তিনি বলেন, ‘এসব কারণে দেশে হৃদরোগ এবং হৃদরোগে মৃত্যু বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশে হৃদরোগে মৃত্যুহার বেশি, সেসব দেশে ৭০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ বেশি মারা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ৭০ বছর বয়সের নিচে মৃত্যু বেশি, সেটাই চ্যালেঞ্জ।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে ভুগছে। প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হৃদরোগ নিয়েই জন্ম নেয়। প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের ৪০ শতাংশ মারা যায়।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শিশু হৃদরোগীরা অত্যন্ত অবহেলিত। শিশুদের চিকিৎসায় ঝুঁকি ও পরিশ্রম বেশি। তাই অনেক চিকিৎসকের তাদের ব্যাপারে আগ্রহ কম। দেশে মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠানে শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান বলেন, ‘রিভার্স পিসিআই পদ্ধতিতে অব্যবহৃত ক্যাথ ল্যাব ব্যবহার করে বহু রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব। বাংলাদেশে এ রকম পিসিআই টিম অপ্রতুল। এই টিম তৈরিতে আমরা কাজ করছি। এ ছাড়া এখনও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা ঢাকাকেন্দ্রিক। তাদের ঢাকার বাইরেও যেতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘দেশে ২০০০ সালের পর কার্ডিয়াক সার্জারি ও হার্টের চিকিৎসার মান অনেক বেড়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সার্জারি হয় না। এটি বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি জানান, প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় ১,৫০০টি, জার্মানিতে হয় ১,২০০টি, আর বাংলাদেশে হয় মাত্র ৮০-৯০টি। সমকাল