> পুনঃতফসিল ঋণের স্থিতি ২৮৮৫৪০ কোটি টাকা
>> ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল হয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকা
>> খেলাপির চেয়ে বেশি পুনঃতফসিল ঋণ
>> মোট ঋণের ৩০ দশমিক ৫৩ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ
ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে দেদার, ফেরত আসছে কম। আবার অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি এবং পর্ষদের সঙ্গে আঁতাত করে নেওয়া অর্থ করা হচ্ছে লুটপাট। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে মন্দ বা খেলাপি ঋণ। এমন পরিস্থিতিতে কাগজে-কলমে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে পুনঃতফসিলের পথ বেছে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে। তা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনঃতফসিল করা অঙ্ক এক বছর হিসাবে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০২৩ সালে শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পুনঃতফসিল করা ঋণের সঙ্গে খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে মন্দ ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় ব্যাংক খাতে ব্যাপকহারে লুটপাট হয়েছে। এস আলমসহ অনেক প্রভাবশালী গ্রুপ নামে বেনামে লাখ লাখ কোটি টাকা ঋণের নামে নিয়ে গেছে। যার অনেক অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পরে এসব ঋণ খেলাপি না দেখাতে পুনঃতফসিলের করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উদার নীতির কারণে ঢালাওভাবে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় পুনঃতফসিল করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হতে শুরু করেছে।
গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে। পরের বছর ২০২০ সালে পুনঃতফসিল কম হয়। ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে করা হয় ২৬ হাজার ১১০ কোটি, ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৪৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
গত বছর পুনঃতফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গত বছরের শেষ দিকে অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, অন্যথায় প্রার্থী হতে পারেন না।
সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সে সময় বাছবিচার ছাড়াই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। কারণ ২০২২ সালের জুলাইয়ে পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়।
যেমন ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয়, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, যা আগে সর্বোচ্চ তিন বছর ছিল। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না। এছাড়া ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। আর ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় খেলাপি ঋণ নবায়ন বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দেওয়াটা ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। উল্টো যে ঋণগুলো পুনঃতফসিল মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধে টালবাহানায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। আইএমএফ পুনঃতফসিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে। পুনঃতফসিল করা ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। একই সময়ে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো ৭১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। সব মিলিয়ে গত বছরের শেষে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। ২০২৩ শেষে মোট ঋণ ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মোট ঋণের ৩০ দশমিক ৫৩ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ২০২৩ সাল শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন, ব্যবসায়িক ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি, ২০২১ সালে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৯০ কোটি, ২০২০ সালে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
পুনঃতফসিল বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বছরের শেষে খেলাপি ঋণ কমানোর একটা চাপ থাকে। কারণ বুক ক্লিন করার জন্য ব্যাংকগুলো নগদ আদায়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি পুনঃতফসিলে ঝোঁকে। এটা প্রতিবছরই হয়ে থাকে। তাই গত বছর রেকর্ড খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।