২০২৩-২৪ অর্থবছর সংশোধিত বাজেটের বাস্তবায়ন হয়েছে ৮৪ শতাংশ। মূল বাজেটের হিসাবে তা আরও কম। সেটি ৭৯ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন প্রায় একই জায়গায় আটকে আছে। প্রতি অর্থবছরেই বড় আকারের বাজেট দেওয়া হয়। ৯ মাস শেষে একবার সংশোধন করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাস্তবায়নের হার আরও কম। তিন বছর ধরে ঘোষিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কম ব্যয় হচ্ছে। এবার মূল বাজেটের চেয়ে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি কম ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ বাজেটের অর্থ ঠিকভাবে ব্যয় করতে পারছে না সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, প্রতিবারই বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটও পুরোটা বাস্তবায়ন হয়নি। ওই অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা হলেও পরে তা সংশোধন করে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এর মধ্য থেকে ব্যয় হয় ৬ লাখ ২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটের ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে যথাযথ সমীক্ষা না করা, যোগ্যতম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে যথাযথ পদে নিয়োগ না দেওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করা এবং বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের প্রাক্কলন ইত্যাদি বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার অন্যতম কারণ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঋণের সুদ পরিশোধ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। উন্নীত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকায়। সরকারের মোট ব্যয়ের যা ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ পরিচালন খাতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে সরকারের নেওয়া দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে।
বাজেট বাস্তবায়নের সমস্যা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক কোনো গবেষণা নেই দেশে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সরকার একটি গবেষণা করে গত বছর। ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ‘সরকারি খরচ ও আর্থিক জবাবদিহি (পিইএফএ) মূল্যায়ন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নের প্রধান দুর্বলতার সঙ্গে জড়িত মূলত বাজেট প্রস্তুতি, জবাবদিহি ও বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি। এ কারণেই মূল বাজেট থেকে বাস্তবায়িত বাজেটের ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। রাজস্ব আয় ও ব্যয়– দু’দিক থেকেই মূল বাজেটের সঙ্গে হেরফের হয় অঙ্কের। আর সরকার খুব কম তথ্যই জনগণের জন্য প্রকাশ করে।
বাজেট বাস্তবায়নের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট ব্যয়ের মধ্যে পরিচালন খাতে ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি ও উন্নয়ন খাতে ৪৩ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সুদ পরিশোধের পাশাপাশি পরিচালন বাজেটের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যয়ের খাত হচ্ছে– সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ ৬৭ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বাবদ ৭২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা।
এদিকে গত অর্থবছরে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এবং অন্যান্য উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এ খাতে প্রকৃত ব্যয় হয় ২ লাখ ১২ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের (সংশোধিত) ৭৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মোট ৫ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নেয় সরকার। এর বিপরীতে ৪ লাখ ৮ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ সম্ভব হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৫ শতাংশ। এনবিআরের ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে অর্জনের হার ৮৮ শতাংশ। অর্জিত হয়নি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া লক্ষ্যমাত্রাও।
এদিকে সরকারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে গত অর্থবছরে ২ লাখ ৩ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৩৫ কোটি এবং বিদেশি উৎস থেকে (নিট) ৭৯ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।