দেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ প্রবীণ। প্রবীণদের ‘সিনিয়র সিটিজেন (জ্যেষ্ঠ নাগরিক)’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে তাদের জন্য রয়েছে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে একটি কর্মপরিকল্পনাও আছে।
কিন্তু, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সহায়-সম্বলহীন প্রবীণরা সরকারি তেমন কোনো সুবিধাই বলতে গেলে পান না। দীর্ঘ ৯ বছরেও কর্মপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা করেই দায় সেরেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অগ্রগতির বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি।
২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিকবার প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনের খসড়া করা হলেও আজও আলোর মুখ দেখেনি। এ আইনটির অগ্রগতির বিষয়েও জানাতে পারেননি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। একজন আরেকজনকে দেখিয়ে দিলেও কারও কাছ থেকে মেলেনি সদুত্তর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে এখন দেড় কোটির মতো প্রবীণ রয়েছেন। মৃত্যুহার কমে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে।
২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩’ করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ষাট ও ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করেন। ২০১৫ সালের ৪ জুন একটি কর্মপরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে পাঠানো হয়।
কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে প্রবীণদের সব ধরনের পরিবহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত, হাসপাতালগুলোতে সাশ্রয়ীমূল্যে আলাদা চিকিৎসাসেবা, আলাদা বাসস্থানের সুবিধা, প্রবীণ স্বাস্থ্যবিমা চালু, নির্বাচন কমিশন থেকে আলাদা পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা ছিল। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো এসব সুবিধা নিশ্চিত করবে।
কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট, কার্যক্রম ও মূল্যায়ন) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি বলতে পারবো না। আপনি অতিরিক্ত সচিব মো. ইব্রাহিম খানের সঙ্গে কথা বলুন।’
প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইব্রাহিম খান বলেন, ‘এটি আমার এখতিয়ারাধীন কাজ নয়। আইন শাখা এটি বলতে পারবে। আপনি যুগ্মসচিব এরশাদ হোসেন খানের সঙ্গে কথা বলুন।’
পরে আইন ও সংস্থা অধিশাখার যুগ্মসচিব এরশাদ হোসেন খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুগ্মসচিব ছরোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলতে পারবেন। আপনি তার সঙ্গে কথা বলেন।’
প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অগ্রগতি জানতে চাইলে যুগ্মসচিব (কার্যক্রম অধিশাখা, অতিরিক্ত দায়িত্ব পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অধিশাখা) ছরোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলতে পারবেন। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সচিব, আপনি সচিবের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন।’
প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা জানান, প্রবীণদের সুরক্ষায় আইন প্রয়োজন। কারণ আইন বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা আছে। আর নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনা করা হলেও তা বাস্তবায়নে বাইরে থেকে তাগিদ দেওয়ার কোনো পক্ষ নেই। তাই সেগুলো পড়ে আছে। বেসরকারিভাবেও প্রবীণদের সুরক্ষায় রয়েছে উদ্যোগের অপ্রতুলতা। তাই প্রবীণদের বড় অংশের জীবন বঞ্চনার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এ এস এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপীই আসলে প্রবীণদের অবস্থা ভালো নয়। মানুষ যে কত অপরিণামদর্শী, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সবাই প্রবীণদের বিষয়ে উদাসীন।’
তিনি বলেন, ‘প্রবীণদের জন্য সরকারের যত উধ্যোগ এর মধ্যে বয়স্কভাতাই একমাত্র সমৃদ্ধ হয়েছে। এছাড়া নীতিমালা করা হয়েছে। সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ আমরা দেখছি না। আইন হলে সেটি বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকে। আমরা ২০১৭ সালে প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনের খসড়া দিয়েছি। কিন্তু সেটিও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। আমরা বহু হাতেপায়ে ধরেছি, কোনো কাজে আসেনি।’
প্রবীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন দ্রুত চূড়ান্ত করে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আতিকুর রহমান বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন প্রবীণদের বড় একটা সুরক্ষা হতে পারে। কিন্তু এটাকে একটা রাজনৈতিক মোড়ক দেওয়ার কারণে সেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি পর্যায়ে প্রবীণদের সুরক্ষায় উদ্যোগও খুবই কম। কারণ বুড়া মানুষের জন্য কোনো ফান্ড পাওয়া যায় না। দেশি-বিদেশি কেউই তাদের বিষয়ে আগ্রহী নয়।’
‘বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুহার কমেছে, মানুষ বুড়া হচ্ছে। প্রবীণদের মধ্যে নারীদের অবস্থা বেশি খারাপ। বিরাট সংখ্যক প্রতিবন্ধী, তারা যখন বয়স্ক হচ্ছে, খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে’ বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক।
অধ্যাপক আতিকুর রহমান আরও বলেন, ‘দেশে দেড় কোটির মতো প্রবীণ আছে। ২০২৫ সালে এদের সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সালে এদের সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা প্রস্তুত নই।’ জাগো নিউজ