খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিগত সরকারের সময়ে ঋণ পুনঃতপশিল, পুনর্গঠন, সহজ শর্তে অবলোপনসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ঋণের বড় অংশই আর আদায় হয়নি। এতে গত বছর ব্যাংকিং খাতের ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণ আরও ১ লাখ ৯ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বেড়ে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। মোট ঋণের যা প্রায় ৩২ শতাংশ। এক বছর আগে এ ধরনের ঋণ ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের কারণে বাংলাদেশকে অনেক ধরনের শর্ত মানতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম একটি শর্ত ব্যাংকিং খাতের ‘ডিসট্রেস অ্যাসেট’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের তথ্য প্রকাশ করতে হবে। মূলত কাগজে-কলমে দেখানো খেলাপি, পুনঃতপশিল ও অবলোপন করা ঋণের অনাদায়ী স্থিতিকে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বলা হয়।
আইএমএফের শর্তের আলোকে ২০২৩ সালের ফাইন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি রিপোর্টে খেলাপি ঋণ, পুনঃতপশিল করা অনাদায়ী ঋণস্থিতি এবং অবলোপন থেকে অনাদায়ী ঋণস্থিতির তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সাল শেষে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণস্থিতি ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মানে প্রতিবছর এ ধরনের ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি ছিল ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পুনঃতপশিল করা অনাদায়ী ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। নিয়মিত খেলাপি হিসেবে দেখানো হয় এমন ঋণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। আগের বছর শেষে ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। আর অবলোপন করে অনাদায়ী রয়েছে ৫৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময়ে ঋণ আদায়ে কঠোরতার চেয়ে বরং বিভিন্ন কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত ব্যবসায়ীদের খুশি করতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকে একের পর এক সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। কখনও নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতপশিল, কখনও ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ১২ বছরের জন্য ঋণ নবায়ন কিংবা পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব ছাপিয়ে করোনার পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে মাত্র ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫০ শতাংশ কিস্তি দিলেই নিয়মিত রাখা হয়েছে। এ রকম বিভিন্ন শিথিলতার কারণে ঋণ পরিশোধ না করার নতুন একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়।
আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের এক সপ্তাহের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ব্যাপক শিথিল করে ঋণ পুনঃতপশিলের একটি নীতিমালা করা হয়। ওই নীতিমালার পর আগের সব রেকর্ড ভেঙে শুধু ২০২২ ও ২০২৩ সালে পুনঃতপশিল হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪১ কোটি টাকার ঋণ। মূলত সুদ মওকুফ, ঋণের মেয়াদ বাড়ানো, বারবার গ্রেস পিরিয়ড নিয়ে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকতেই অনেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছেন। গত বছর পুনঃতপশিল করা হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ। আগের সব রেকর্ড ভেঙে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় যা ৬৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। সংস্থাটি ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত দিয়েছে। তবে এই খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য আগের মতো আর নীতি সহায়তা দেওয়া যাবে না। বরং ২০১৯ সাল থেকে মেয়াদি ঋণ এক বছর কোনো কিস্তি না দিলেও তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে বিবেচনা করার যে বিধান করা হয়, তা উঠে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিশেষ ব্যবস্থায় আর ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আগেই খেলাপি হওয়া চিত্র এখন সামনে আসছে।