বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর পাঁচ মাস আগের কথা। সচিবালয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কক্ষে তিন-চার জন লোক বসা। এ সময় একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রীর কক্ষে এলেন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) শরীফ মাহমুদ অপু। হাতে একটি কাগজ। কথা থামিয়ে মন্ত্রী কাগজটা হাতে নিলেন। দেখলেন, এরপর তাকালেন। পিআরও মাথা নাড়িয়ে সাংকেতিক ইশারা দিলেন। মন্ত্রী কলমদানি থেকে কলম নিয়ে একটি ইনিসিয়াল দিয়ে কাগজটি পিআরওর সঙ্গে আসা উপসচিবের হাতে দিলেন। বেরিয়ে গেলেন দুজনেই। মন্ত্রী আবার দৃষ্টি ফেরালেন টেবিলের সামনে বসা লোকদের দিকে। পিআরও’র হাতে থাকা সেই কাগজটি আসলে কিসের, যা স্বাক্ষর করার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মাথা নাড়িয়ে ইশারা দিয়েছিলেন অপু-তা জানতে উৎসাহ জাগল। উপসচিবের পিছু নিলেন দুজন গণমাধ্যমকর্মী। জানতে চেয়ে উত্তর পাওয়া গেল না। ততক্ষণে যুগ্ম সচিব তার কক্ষে ঢুকে কম্পোজ করতে দিলেন মন্ত্রীর স্বাক্ষর দেওয়া সেই চিঠিটি। কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা পিআরও অপুর জন্য। অপু বের হলেন চিঠিটি নিয়ে। জানতে চাইলেন গণমাধ্যম কর্মীরা-‘সচিবের বদলির অর্ডার?’ অপু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘সচিব না, এসপি বদলি।’ আবারও প্রশ্ন ‘কজন?’।
অপু বললেন, ‘ছোট অর্ডার, তিনজন এসপি পদায়ন ও বদলি।’ দেখালেন প্রজ্ঞাপনটি। কাগজটা একঝলক দেখিয়ে সরিয়ে নিলেন চতুর এই পিআরও। একদিন অপেক্ষার পর জানা গেল, তিনজন এসপি নতুন জেলায় বদলি করার আদেশটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মতি নিতে এসেছিলেন তারা। পরের দিন প্রজ্ঞাপনটি দেখেই গণমাধ্যমকর্মীদের জানার অবসান ঘটল।
বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমে বদলি হওয়া এসপির ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে জানা গেল কী পেয়েছিলেন পিআরও? জানা গেল এসপি বদলিতে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা দিতে হতো সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্যাশিয়ার খ্যাত শরীফ মাহমুদ অপুকে। ঘুষের টাকার একটি অংশ নিজে রেখে বাকিটা রাতে ধানমন্ডির বাসায় মন্ত্রীর ছেলের হাতে বুঝিয়ে দিতেন। এভাবেই আসাদুজ্জামান খান কামাল, তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও ছেলের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ বেতারের ২৮ ব্যাচের (অনুষ্ঠান) এই কর্মকর্তা। তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন স্বরাষ্ট্রের সব স্তরের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তথ্য কর্মকর্তা বলেন, এই অপু বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্নীতিবাজ তথ্য কর্মকর্তা হিসাবে সব মহলে পরিচিত।
দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুর্নীতির মামলায়ও আসামি হয়েছেন শরীফ মাহমুদ অপু। এই দুজনসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট আরও পাঁচজনের বিদেশ গমনে দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অপুর বাসা থেকেও তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। এর পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পূর্ণমতি গ্রামের জয়নাল আবেদিনের সন্তান শরীফ মাহমুদ অপু বেতারের চাকরিতে যোগদানের পরেও টানাটানির মধ্য দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছিলেন জীবন। তবে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে পুরোপুরি বদলে ফেলেন নিজেকে। পূর্ণমতি গ্রামের সাজ্জাদ খান বলেন, এই অপু বাড়িতে এলে পুলিশ তাকে প্রটেকশন দিতো। এগুলো দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। তার ক্ষমতার প্রভাব এতটাই ছিল যে, কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি তার বাবা জয়নাল আবেদিনকে বুড়িচং সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন এবং পূর্ণমতি এম এ উচ্চ বিদ্যালয় কমিটির সভাপতিসহ নানা পদপদবির দায়িত্বে বসিয়েছিলেন। এই স্কুলের ভেতরে তার একটি প্রাইভেট রুম ছিল। স্কুলের অভিভাবক জালাল বলেন, এই জয়নাল এখানে অসামাজিক কার্যকলাপ করতেন। তার ছেলের ক্ষমতার ভয়ে কেউ কিছু বলত না।
অপুর সম্পদের পাহাড় : শরীফ মাহমুদ অপু তেজগাঁও-হাতিরঝিল থেকে নির্বাচিত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রায় দশ বছর জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন। অবৈধ আয়ের অর্থে বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট এমনকি ব্যাংককের পাতায়ায় রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন। রাজধানীর বসুন্ধরা, উত্তরা ও গুলশানে বেশ কয়েকটি দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছেন। নিজের ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে রয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পুলিশের এসপি, ওসি ও এসআই বদলির পাশাপাশি তিনি অন্তত অর্ধশত ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছেন। যার বিনিময়ে অপু নিজের এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের জন্য নিয়েছেন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে। এসব টাকার বড় একটি অংশ দিতে হতো কামালের ছেলে অথবা তার স্ত্রীর কাছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল পালিয়ে যাওয়ার পরও জোর করে এই মন্ত্রণালয়ে থাকতে চেয়েছিলেন অপু। নতুন পিআরও নিয়োগের পরও তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ার পাশাপাশি নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশে বাধা দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কক্ষটি ছেড়ে বিদায় নেন।
এদিকে দুদক সূত্রে জানা গেছে, অপুর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দাখিলের পর তাকে ডাকা হয়েছিল। দুদকে হাজিরাও দিয়েছেন তিনি। তার অর্থসম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন অপু।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পালিয়ে যাওয়া আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আয়ের উৎস তদন্তে নামছে দুদক। এতেও নাম এসেছে অপুর। এদিকে বর্তমানে আত্মগোপনে থাকায় শরীফ মাহমুদ অপুর কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।(যুগান্তর)