গত এক বছর ধরে চরম বিপজ্জনক অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য। তার মধ্যে গত সপ্তাহটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এ সময়ে সর্বাত্মক একটি যুদ্ধের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। বিশেষ করে এ সময়ে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে লেবাননে হত্যা করেছে ইসরাইল।
লেবাননে আকাশপথে বিমান হামলাসহ স্থল আগ্রাসন শুরু করেছে তারা। ইরান প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরাইলের বিভিন্ন টার্গেটে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। অবিলম্বে এই অবস্থা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানিসহ জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য সর্বাত্মক একটি যুদ্ধের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। গত সপ্তাহের শুক্রবার। তখন সবেমাত্র সূর্য ডুবেছে।
লেবাননের রাজধানী ও দক্ষিণের শহর বৈরুতে ধারাবাহিকভাবে বিকট সব বিস্ফোরণ হয়। বেশ কিছু এপার্টমেন্ট ভবনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তা মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ধ্বংসস্তূপের ধুলোবালি, ধোয়া আকাশে উঠে যায়। সারা লেবানন থেকে তা দৃশ্যমান হয়। আন্ডারগ্রাউন্ডের বাঙ্কারে এ সময় হাসান নাসরাল্লাহ তার কিছু কমান্ডারকে নিয়ে বৈঠক করছিলেন। তাকে টার্গেট করে এ হামলা চালানো হয়। এতে নিহত হন তিনি। একে ইসরাইল তাদের সবচেয়ে বড় সফলতা হিসেবে দেখে। কারণ, বহু বছর ধরে তাকে টার্গেট করেছিল ইসরাইল।
এ সপ্তাহে ইসরাইলের হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ৫০০ লেবানিজ। উত্তেজনা প্রশমনের যে আশা করা হয়েছিল তা শেষ হয়ে যায় নাসরাল্লাহকে হত্যার মধ্য দিয়ে। অথচ এর কযেক ঘণ্টা আগেও উত্তেজনা প্রশমনের একটি সুযোগ দেখা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ২১ দিনের একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের পাশাপাশি আলোচনা করছিল। সেখানে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন পর্যন্ত বলেন, তার দেশ এ ধারণার বিষয়ে মুক্ত। কিন্তু হামলার কয়েক ঘণ্টা পরে জাতিসংঘ থেকে আগেভাগেই ইসরাইল ফেরেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামি নেতানিয়াহু। কূটনৈতিক উদ্যোগে সমাধানের যে আশা করা হচ্ছিল তা ম্লান হয়ে যায়।
তিনদিন পরে ইসরাইলি সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে লেবাননে প্রবেশ করে। তারা স্থল আগ্রাসন শুরু করে। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) বলে, তাদের এই অভিযান হবে সীমিত ও টার্গেটেড। কিন্তু ইসরাইলের হামলায় লেবাননের প্রায় ১২ লাখ মানুষ গৃহহারা। এ সময়ে হত্যা করা হয়েছে ইসরাইলি ৮ সেনা সদস্যকে। ইসরাইলের দাবি তারা সীমান্ত এলাকা থেকে হিজবুল্লাহর রকেট ও ড্রোন উড়ানোর সক্ষমতা বন্ধ করতে চায়। এমনটা বলেই তারা হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে গাজাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলেছে। ইসরাইলি সেনারা এখন একই সঙ্গে দুটি স্থানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। একটি গাজায়। অন্যটি লেবাননে। বহু দশকের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি। এরআগে সর্বশেষ ২০০৬ সালে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। জাতিসংঘের রেজ্যুলুশন ১৭০১ এর অধীনে এই যুদ্ধ শেষ হয়। লেবাননের দক্ষিণ থেকে সদস্যদের প্রত্যাহার করে হিজবুল্লাহ। এরপর ইরানের সমর্থন নিয়ে শক্তিশালী হতে থাকে হিজবুল্লাহ।
পরের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্থানীয় সময় সাড়ে সাতটার দিকে ইসরাইলজুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। বাজানো হয় সাইরেন। এক কোটি ইসরাইলি দৌড়ে গিয়ে বোমা বিষয়ক আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ সময় প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়। হামলা বন্ধ করার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন। এতে যুদ্ধ আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আইডিএফ বলেছে, বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। অল্প কিছু সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের কেন্দ্রস্থলে এবং দক্ষিণে আঘাত করেছে। তবে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে তারা মুখ খোলেনি। এই হামলা ইরানের সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তবে তারা এর মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর দৃশ্যত কোনো বাসনা পোষণ করেনি।
হিজবুল্লাহর ভয়াবহ ক্ষতি সত্ত্বেও তারা লেবাননে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। ইতিহাস বলে যে, লেবাননে প্রবেশ করা ইসরাইলের জন্য সহজ। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। ইরানের হামলার জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ইসরাইল। ফলে মঙ্গলবার থেকে ওই অঞ্চল এবং বিশ্ব আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রতিশোধ নেয়া হিসেবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা অথবা তেল বিষয়ক স্থাপনাকে টার্গেট না করতে ইসরাইলকে উৎসাহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু নেতানিয়াহু কঠোর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছেন। তিনি দৃশ্যত ইরানের শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন চান।