উচ্চ সুদ পেতে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সরকারি বিল ও বন্ডে খাটাচ্ছেন অনেকে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সবাই এখন শূন্য ঝুঁকির এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। ব্যাংকগুলোও গ্রাহককে দেওয়ার চেয়ে সরকারকে ঋণ দিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে।
এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ঋণের খরচ যেমন বাড়ছে, ঋণ পাওয়াও অনেক কঠিন হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে কর্মসংস্থান হচ্ছে কম। অন্যদিকে, সরকারের ঋণের সুদ খরচও অনেক বাড়ছে। সংকট মেটাতে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকে কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়মিত ধরনা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারের ঋণ নেওয়ার মাধ্যম ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ২০ শতাংশ ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ। কয়েক বছর আগে যা ১ শতাংশের কম ছিল। গত জুন পর্যন্ত বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে যা ছিল ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এক বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে ৫১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যক্তি বিনিয়োগ ২৬০ শতাংশের বেশি বেড়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে যা মাত্র ১ হাজার ১০২ কোটি টাকা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও সমানতালে বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যে কারণে ঋণকে আরও ব্যয়বহুল করে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। চলতি বছরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের সুদহার ছয় দফা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আবার সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিচ্ছে না কোনো ঋণ। উল্টো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের দেনা পরিশোধ করছে। এতে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ৫ নভেম্বর তিন বছর মেয়াদি বন্ডে ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়েছে সরকার। একই দিন দুই বছর মেয়াদি বন্ডে সুদহার ছিল ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ। এখন এক বছর মেয়াদি বিলে ১২ শতাংশ, ছয় মাস মেয়াদি বিলে ১১ দশমিক ৯০ এবং ৯১ দিন মেয়াদি বিলে ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টাকা তুলে ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করায় ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট হচ্ছে। সুদসহ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ব্যাংকের আমানত মাত্র ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়ে ১৭ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে নেমেছে। আমানত ও ঋণে সাম্প্রতিক কোনো বছরে এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের আমানত ভেঙে অনেকেই এখন বিল ও বন্ডে রাখছেন। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আমানত কমছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আয় বাড়ানো গেলে সরকারের ঋণ চাহিদা কমবে। আবার মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলে এত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থাকবে না। তখন সুদহার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
ব্যাংকাররা জানান, সাধারণভাবে মানুষ টাকা রাখার ক্ষেত্রে সবার আগে যথাসময়ে ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তার বিষয়টি দেখে। আবার যে কোনো সময় ভাঙানোর সুবিধা অগ্রাধিকার দেয়। মেয়াদ পূর্তির আগে মেয়াদি আমানত কিংবা সঞ্চয়পত্র ভাঙালে অনেক কম সুদ পাওয়া যায়। তবে ট্রেজারি বিল বা বন্ডে যে কোনো সময় ভাঙালেও নির্ধারিত মেয়াদের পুরো সুদ পাওয়া যায়। বাজারে সুদহার কমলেও এখানে কমে না। আবার সরকারি হওয়ায় এত নিশ্চয়তা কোথাও নেই। টাকার উৎস জানাতে হয় না। সঞ্চয়পত্রের মতো ট্যাক্স রিটার্ন সনদ জমার বাধ্যবাধকতা নেই; বরং পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে কেনা যায়। টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে নেই কোনো ঝুঁকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে। এ সময়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার অনেক বেড়েছে। নিরাপত্তা ও বেশি সুদের কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অনেকেই ট্রেজারি বিল বা বন্ডে রাখছেন। আবার সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন কঠোর নিয়মের কারণে সেখান থেকে টাকা তুলে অনেকে বিল-বন্ড কিনছেন। ব্যাংকগুলোকে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।
ব্যাংকাররা জানান, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এই বছরের শুরু থেকে জোর করে কয়েকটি ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বেশ আগে থেকেই কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এর মধ্যে সরকার পতন ও ১১ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মিলিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়েছে। কিছু ব্যাংক এখন আর চাহিদামতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া পুরো ব্যাংক খাতের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি নেই। এর বিপরীতে কোনো প্রভিশন রাখতে হয় না। অথচ সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারে না। এখানে টাকা রাখতে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ এবং এর বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয়। এ ছাড়া ৫ লাখ, ১৫ লাখ, ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ এভাবে বিনিয়োগ যত বেশি, তত কম সুদ দেওয়া হয়। মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙালে সুদহার অনেক কম পাওয়া যায়। এসব কারণে গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা কমেছে। অবশ্য চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বেড়েছে ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজার এই ভালো তো এই খারাপ। ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে উৎসে কর কাটা হয়। এক লাখ টাকার বেশি জমার ওপর আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এর বাইরে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের মাশুল কেটে নেয়। ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ অনেক বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, প্রকৃত সুদহার ঋণাত্মক। যে কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে এখন বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। সমকাল