ঋণ নেওয়া এমন কোনো মামুলি বিষয় নয় যে, ইচ্ছামতো নিয়ে ভোগ করলাম, পরে আর তা পরিশোধ করলাম না। বরং ঋণের দায়বদ্ধতা বড় কঠিন এবং এর পরিণতি ভয়াবহ। হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ (সা.) ঋণকে ‘মহব্বত ও ভালোবাসার কাঁচি’ বলে উল্লেখ করেছেন। ঋণ আত্মীয়তা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বিনষ্ট করে দেয়। এজন্য যথাসম্ভব ঋণ না নিয়ে অল্পে তুষ্ট থাকা উচিত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ঋণগ্রহীতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের আগে ঋণ আদায় করার কথা বলেছেন। (সূরা নিসা, আয়াত : ১২)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৫৮)।
ঋণ বান্দার হকের অন্তর্ভুক্ত, এজন্য পরিশোধ করা ছাড়া এর দায়বদ্ধতা থেকে ঋণগ্রহীতা কোনোভাবেই মুক্তি পাবে না। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! আল্লাহর রাস্তায় কেউ শহিদ হলো, সে আবার জীবিত হলো, আবার শহিদ হলো, অতঃপর জীবিত হয়ে আবার শহিদ হলো, তবুও সে জান্নাতে যাবে না, যতক্ষণ না সে স্বীয় ঋণ পরিশোধ করবে।’ (সহিহ বুখারি)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় ঋণ থেকে আশ্রয় কামনা করতেন এবং একে কুফরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় ঋণ ও কুফর থেকে আশ্রয় চাইতেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! উভয়টা কি সমান? তিনি বললেন, হ্যাঁ, উভয়টা সমান।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে গোনাহ ও ঋণ থেকে আশ্রয় চাই। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার ঋণ থেকে অধিক পরিমাণে আশ্রয় চাওয়ার কারণ কী? তিনি বললেন, মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয়, তখন সে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদার বরখেলাপ করে।’ (সুনানে নাসায়ি)। ঋণ গ্রহণ অপমানের প্রতীক। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন আল্লাহতায়ালা কোনো বান্দাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে চান, তখন তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবু দাউদ)।
সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ আদায়ে গড়িমসি করা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। আর জুলুমের শাস্তি ভয়াবহ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অযথা ঋণ আদায় করবে না, সে জালিম।’ (সহিহ মুসলিম)। অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে লোক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ আদায়ে গড়িমসি করবে, সে প্রতিদিন, প্রতি শুক্রবার এবং প্রতি মাসে জালিম উপাধিতে ভূষিত হবে।’ (সুনানে তাবরানি)। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঋণ আদায়ে গড়িমসিকারীকে ‘আল্লাহর শত্রু’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। স্ত্রীর মোহরানাও ঋণের অন্তর্ভুক্ত। অনাদায়ে স্বামীর ঘাড়ে তা ঋণস্বরূপ বহাল থাকবে। হজরত শুআইব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিয়ের সময় মোহরানা নির্ধারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু তা আদায়ের নিয়ত ছিল না, তবে সে ব্যক্তি ব্যভিচারী হয়ে মরবে।’ (সুনানে তাবরানি)।
কিয়ামত দিবসে ঋণখেলাপি ব্যক্তি স্বীয় ঋণ পরিশোধ করা ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। কিন্তু সেদিন তা পরিশোধ করার জন্য টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না কিছুই থাকবে না। এজন্য ঋণ পরিশোধ করতে হবে নেক আমলের মাধ্যমে। যদি তা না থাকে, তাহলে ঋণদাতার পাপের বোঝা বহন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে কিয়ামত দিবসে তা পরিশোধ করতে কোনো দিনার দেরহাম (টাকা-পয়সা) কিছুই থাকবে না। শুধু পাপ ও নেক আমল অবশিষ্ট থাকবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)। আল্লাহতায়ালা সবাইকে ঋণগ্রস্ত হওয়া থেকে হেফাজত করুন। অল্প তুষ্টির জীবন দান করুন। আমিন।
(যুগান্তর)