ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের লাইন-৫ (এমআরটি-৫ দক্ষিণ লাইন)-এর নির্মাণকাজ আপাতত বাদ দিয়েছে সরকার। প্রকল্প পর্যালোচনায় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বড় ব্যয়ের প্রকল্পটির যে রুট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সেবা সৃষ্টির দিক থেকে সুবিধাজনক নয়।
একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের আবাসিক প্রকল্পের চাহিদা তৈরির উদ্দেশ্যে বিগত সরকারের সময় প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। জনসেবার অগ্রাধিকার বিবেচনা থেকে প্রকল্পটির রুট পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয়ও বেশি ধরা হয়েছে। এ রকম একাধিক কারণে প্রকল্পটি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য উদ্যোগী মন্ত্রণালয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ফেরত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
চলতি বছর ঢাকার গাবতলী থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। ২০২২ সালেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করা হয়। এ বাবদ কিছু অর্থ ব্যয় হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনা শেষে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কারণে প্রকল্পটির অনুমোদন আটকে যায়।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কৌশলগত কারণে প্রকল্পটি অধিকতর যাচাইয়ের কথা বলে মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে। তবে মূল কথা হচ্ছে, প্রকল্পটি আপাতত বাদ। এর পরিবর্তে একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শুধু বিগত সরকারের একাধিক নেতার ইচ্ছায় দাশেরকান্দি ও আফতাবনগর এলাকাকে প্রকল্পের রুট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, রুটটি একটি আবাসিক এলাকা। বড় ব্যয়ের প্রকল্প হিসেবে আবাসিক এবং বাণিজ্যিকসহ যত ধরনের নাগরিক প্রয়োজনে বেশি ব্যবহার হয়, সে বিবেচনা করা হয়নি। বরং গুলিস্তান, সদরঘাট, নিউমার্কেট অনেক বেশি জনবহুল। এসব এলাকা সংযুক্ত হলে অনেক বেশি মানুষ প্রকল্পটির সেবা পাবে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বলেন, মেট্রোরেলকে শুধু একটা গণপরিবহন হিসেবে ভাবা ঠিক হবে না। এটি একটা উন্নয়ন উপকরণ। এ ধরনের গণপরিবহনকে কেন্দ্র করে নতুন শহরাঞ্চল গড়ে ওঠে। সে বিবেচনায় গোটা নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মেট্রোরেলকে দেখা উচিত। অন্যদিকে মেট্রোরেল মোটা অঙ্কের বিনিয়োগের প্রকল্প। এসব কারণে কত বেশি যাত্রীকে সেবা দেওয়া যায়, সে সুবিধার বিবেচনা থেকে রুট পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। মেট্রো-৫ প্রকল্পটির আর্থসামাজিক-বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা যাচাই করা দরকার। বাদ দেওয়ার বিষয়টি যাচাইয়ের নিরিখেই হওয়া উচিত। অগ্রাধিকারও সাজাতে হবে সেভাবেই।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বড় এবং আলোচিত কিছু প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ জানতে চান। এতে কমিশনের পক্ষ থেকে এমআরটি-৫ দক্ষিণ রুটের বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বড় ব্যয়ের প্রকল্প হিসেবে প্রকল্পের রুটটি সেবা সৃষ্টির দিক থেকে সুবিধাজনক নয়। অধিক সেবা সৃষ্টির সুবিধা বিবেচনায় প্রস্তাবিত রুটটি বাদ দিয়ে এমআরটি লাইন-২ বাস্তবায়ন করা যুক্তিযুক্ত। বিবেচনায় থাকা এ প্রকল্পটির পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকার সঙ্গে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে।
রাজধানীর পূর্ব-পশ্চিম সংযোগকারী প্রকল্প হিসেবে মেট্রোরেল-৫ দক্ষিণ গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মোট ১৫টি স্টেশনের কথা বলা হয়। রুট পরিকল্পনায় ছিল গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, আফতাবনগর, আফতাবনগর সেন্টার, আফতাবনগর পূর্ব, নাসিরাবাদ এবং দাশেরকান্দি। ১৭ দশমিক ২ কিলোমিটারের প্রকল্প প্রস্তাব গত মার্চে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়। এপ্রিলেই প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্পটির ব্যয় নিয়ে আপত্তি ওঠে। ডিপিপিতে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ আসে। প্রকল্পটিতে ঋণ ও সুদ পরিশোধ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছে, যা আর্থিক ও পরিকল্পনার শৃঙ্খলা পরিপন্থি। কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় প্রাক্কলনের ব্যাপক পার্থক্যের কারণ কী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। প্রকল্পের ১ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা পরামর্শক ব্যয় নিয়েও প্রশ্নে ওঠে পিইসি সভায়।
এমআরটি-৫ বড় অঙ্কের বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের যৌথভাবে ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা। বাকি ১৫ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করে প্রকল্পে প্রধান ঋণদাতা সংস্থা এডিবি এবং অন্য ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাঠামো চুক্তি হয় চার বছর আগে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ডিএমটিসিএলের এক পর্যালোচনায় প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ৬ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা কমানো হয়।
প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব বলেন, রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণকেন্দ্রিক একাধিক সড়ক অবকাঠামো আছে। তবে পূর্ব-পশ্চিমকেন্দ্রিক অবকাঠামো কম। রাজধানীর যোগাযোগ কাঠামোতে ভারসাম্য আনার লক্ষ্যেই মেট্রো-৫ দক্ষিণ প্রকল্পটির নকশা উন্নয়ন করা হয়। কাজ অনেকদূর এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রস্তুত। কিছুটা দেরিতে কাজ শুরু হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০-২০৩১ সালে নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব। সমীক্ষায় দেখা গেছে, অর্থবছরে যাত্রীরা এ মেট্রো ব্যবহার করলে মোট ২১ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। বছরে জ্বালানি সাশ্রয় হবে ৪১ দশমিক ২২ হাজার টন। রাস্তায় ১ হাজার ৪৯টি গাড়ির চলাচল কমে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে পর্যালোচনার পরামর্শে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় কমানো হয়েছে সম্প্রতি। তারপরও প্রকল্প বাদ দেওয়া কিংবা বাস্তবায়ন করা এখন সরকারের ইচ্ছার বিষয়। সমকাল