‘শবে বরাত’ নাকি ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’? বাংলাদেশে এ রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ফারসি ভাষায় শব-এর অর্থ রজনী বা রাত। আর বরাত অর্থ ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাতের অর্থ দাঁড়ায় ভাগ্য রজনী।
আবার ‘বারায়াত’কে যদি আরবি শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন আল কুরআন মাজিদে বারায়াত নামে একটি সূরা রয়েছে, যা সূরা আত তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা’। [সূরা ৯, আত তাওবা-১] এখানে বারায়াতের অর্থ হলো সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন; ‘তোমাদের মধ্যকাররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? নাকি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে’? [সূরা ৫৪, আল কামার-৪৩]
শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবিতে তরজমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। অর্থাৎ সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবি ও ফারসি ভাষায় একই রকম, কিন্তু‘ অর্থ ভিন্ন। যেমন, ‘গোলাম’ শব্দটি আরবি ও ফারসি উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একই ভাবে উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু আরবিতে এর অর্থ হলো কিশোর আর ফারসিতে এর অর্থ হলো দাস। মোট কথা হলো- ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবি শব্দ ধরা হলে তার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসি শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য। আরবি ভাষার সঙ্গে ফারসি ভাষার সংযোগ করলে ইসলামী শারিয়াত হয় না।
মূলত: এই পরিভাষাটি কুরআন বা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং একটি আয়াতের অসতর্ক ব্যাখ্যা থেকেই এ ধরনের নামকরণ হতে পারে।
আল কুরআনে শবে বরাত
১। শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন এই শব্দটি আল কুরআনুল মাজিদে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, পবিত্র আল কুরআন মাজিদে শবে বরাতের কোনো আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা, আকার ইঙ্গিতেও নেই। অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে গিয়ে সূরা দুখানের প্রথম ৪ আয়াত পাঠ করেন।
‘হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়'(সূরা আদ দুখান:১-৪)।
‘বরকতময় রাত’ বলতে অসাবধানতাবশত কেউ কেউ মধ্য শাবান বা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। অথচ এর দ্বারা যে রমাজান মাসে অবস্থিত কদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে, তা একটি অকাট্য বিষয়।
এজন্যই ইবনুল কায়্যীম (র.) বলেন, “এটি অকাট্যভাবে কদরের রাত্রি। কারণ আল্লাহ বলছেন, “নিশ্চয়ই আমি কোরআনকে কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি”। আর যারা শাবানের মধ্যরাত ধারণা করছে, তারা আসলে ভুল করছে”।
ইবনু কাসিরও বলছেন, “যারা শাবানের মধ্য রাত্রি বলছেন, তারা বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। বরং এটি যে রমাজান মাসের একটি রাত, সে ব্যাপারে কুরআনের ভাষা সুস্পষ্ট”।
এভাবে প্রমাণিত হলো- কোরআনের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ রাতের কোনো উল্লেখ নেই। বরং একাধিক হাদিসে এ রাতের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এখানে স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, যারা এখানে বারাকাতময় রাতের অর্থ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মতো অপরাধ। কারণ হলো প্রথমত; আল কুরআন মাজিদের এ আয়াতের তাফসির বা ব্যাখ্যা সূরা আল কদর দ্বারা করা হয়।
সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এটা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রাতে। আর মহিমান্বিত রাত সম্বন্ধে আপনি জানেন কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ঐ রাতে (মালাইকা) ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি! সেই রাত ফাজরের উদয় পর্যন্ত।’
[সূরা ৯৭, আল কাদর-১-৫]
অতএব বারাকাতময় রাত হলো লাইলাতুল কদর। ১৫ই শাবানের রাত নয়। সূরা দুখানের প্রথম চার আয়াতের ব্যাখ্যা হলো এই সূরা আল কাদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করাই হলো সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
২। সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত (১৫ই শাবানের রাত) হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল কুরআন নাযিল হয়েছে রমজান মাসের লাইলাতুল কাদরে। যেমন; সূরা আল বাকারা-১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন। কেননা আল কুরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে’।
৩। অধিকাংশ মুফাসসিরে কিরামের মত হলো উক্ত আয়াতে বারাকাতময় রাত বলতে লাইলাতুল কাদরকেই বুঝানো হয়েছে।
হাদিসে শবে বরাতের আলোচনা:
প্রশ্ন থেকে যায় হাদিসে কি লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত নেই? সত্যিই সহিহ হাদিসের কোথাও কেউ শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত নামের কোনো রাতের নাম খুঁজে পাবে না। যে সকল হাদিসে এ রাতের কথা বলা হয়েছে তার ভাষা হলো ‘লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি। শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দ আল কুরআনে নেই, হাদিসেও নেই। এটা মানুষের বানানো একটা শব্দ। ভাবতে অবাক লাগে যে, একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে অথচ এর আলোচনা আল কুরআনে নেই, সহিহ হাদিসেও নেই। অথচ আপনি দেখতে পাবেন যে, সামান্য নফল আমলের ব্যাপারেও হাদিসের কিতাবে এক একটি অধ্যায় বা শিরোনাম লেখা হয়েছে:
১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যখন ১৫ই শাবানের রাত আসবে তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করবে এবং এ দিনে সিয়াম পালন করবে। কেননা সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আল্লাহ পৃথিবীর নিকটস্থ আকাশে অবতরণ করেন। তারপর তিনি বলেন: আমার কাছে কেহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। কোনো জীবিকার প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিযক দিবো। কোনো রোগগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে শিফা দান করবো। এভাবে তিনি বলতে থাকেন, অবশেষে ফাজরের সময় হয়ে যায়। [ইবন মাজাহ/১৩৮৮]
২। আয়িশা (রা.) বলেছেন- ‘এক রাতে আমি নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (বিছানায়) না পেয়ে তার খোঁজে বের হলাম। আমি দেখতে পেলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে, তার মাথা আকাশের দিকে উত্তোলন করে আছেন। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে ‘আয়িশা। তুমি কি এই আশংকা করছ যে, আল্লাহ এবং তার রাসূল তোমার উপর অবিচার করবেন? ‘আয়িশা (রা.) বলেন, আমি বললাম: এত আমার জন্য আদৌ সমীচিন নয়। বরং আমি মনে করেছি, আপনি আপনার অপর কোনো বিবির কাছে গেছেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: মহান আল্লাহ ১৫ই শাবানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়েও অধিক লোককে ক্ষমা করেন। [ইব্ন মাজাহ/১৩৮৯]
৩। আবূ মূসা আশ’আরী (রা.) সূত্রে থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ ১৫ই শাবানের রাতে রহমতের দৃষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তার সৃষ্টির সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দেন। [ইবন মাজাহ/১৩৯০]
হাদিসে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শাবানের ১৫তম রজনী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই শবে বরাত না বলে এ রাতকে “‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’” বলাই শ্রেয়। কারণ, এটিই হাদিসের দেয়া নাম।
তবে বরাত বলতে যদি আরবি (বারাআহ) কে বুঝানো হয়, তাহলে অনেকটা মেনে নেয়া যায়। যার অর্থ, মুক্তি বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। তাহলে পুরো অর্থ দাঁড়াবে, গুনাহ বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত। কারণ হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, এ রাতে এমনটি ঘটে থাকে।
শবে বরাত সম্পর্কিত তথা কথিত প্রচলিত বিশ্বাস ও আমল
১। উপরোক্ত ১নং হাদিসটি এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (র.) বলেছেন, হাদিসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল।
২। অপর একটি সহিহ হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে ১নং হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সহিহায়িন হাদিস নামেও পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটি হলো- আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমাদের রাব্ব আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেন : কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবূল করবো। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করবো। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করবো। [বুখারী/১০৭৪, মুসলিম/১৬৪২]
আর উল্লিখিত ১ নং হাদিসের বক্তব্য হলো- আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবূলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত এই সহিহ হাদিসের বক্তব্য হলো আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবূলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদিসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং সহিহায়িন ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। তাই হাদিসটি প্রসিদ্ধ। অতএব এই মশহুর হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে ১নং হাদিসটি গুরুত্ব পায় না। কারণ একদিন বাদে অন্য রাতগুলোতে মানুষদেরকে ইবাদাত করতে নিরুৎসাহীত করে। ফলে লোকদের ক্ষমা চাওয়ার দরজা সংকুচিত করা হয়।
বরং উপরোক্ত ২নং হাদিসে দেখা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িতা আয়িশা (রা.)কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকেও। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রমজানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। অন্যদেরকে বেশি পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোনো ইবাদত করার ফাজিলত থাকত তাহলে রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশা (রা.)কে বললেন না? কেন রমজানের শেষ দশকের মতো সকলকে জাগিয়ে দিতেন না, তিনি তো সৎ কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তো কোনো অলসতা বা কৃপণতা করেননি। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীন সমন্ধে জানা ও বুঝার তাওফীক দান করুন।
শবে বরাত যারা পালন করেন তারা শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধারণা, যে সকল কাজ করেন তা হলো-
তারা বিশ্বাস করে যে, ১৫ই শাবানের রাতে আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রাণীর এক বছরের খাওয়া-দাওয়া বরাদ্দ করে থাকেন। এই বছর যারা মারা যাবে ও যারা জন্ম নিবে তাদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ রাতে বান্দার পাপ ক্ষমা করা হয়। এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে সৌভাগ্য অর্জিত হয়। এ রাতে আল কুরআন মাজীদ লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে নাযিল করা হয়েছে। এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। মৃত ব্যক্তিদের রূহ এ রাতে দুনিয়ায় তাদের সাবেক গৃহে আসে। এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরি করে নিজেরা খায় ও অন্যকে দেয়া হয়। বাড়িতে বাড়িতে মিলাদ পড়া হয়। আতশবাজী করা হয়। সরকারী-বেসরকারী ভবনে আলোক সজ্জা করা হয়। সরকারী ছুটি পালিত হয়। পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করা হয়। কাবরস্থানগুলোতে আগরবাতি ও মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়। লোকজন দলে দলে কাবরস্থানে যায়। মাগরিবের পর থেকে মাসজিদগুলো লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যারা পাঁচ ওয়াক্ত সলাতে ও জুমু‘আয় মাসজিদে আসে না তারাও এ রাতে মাসজিদে আসে।
মাসজিদগুলোতে মাইক চালু করে ওয়াজ নসীহাত করা হয়। শেষ রাতে সমবেত হয়ে দু‘আ মুনাজাত করা হয়। বহু লোক এ রাতে ঘুমানোকে অন্যায় মনে করে থাকে। বিশেষ পদ্ধতিতে একশত রাক‘আত, হাজার রাক‘আত ইত্যাদি সালাত আদায় করা হয়।
লোকজন ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, ‘হুজুর! শবে বরাতের সলাতের নিয়ম ও নিয়াতটা একটু বলে দিন।’ ইমাম সাহেব আরবি ও বাংলায় নিয়াত বলে দেন। কিভাবে সালাত আদায় করবে, কোন রাক‘আতে কোন সূরা তেলোওয়াত করবে তাও বলে দিতে কৃপণতা করেন না। যদি এ রাতে ইমাম সাহেব বা মুয়াজ্জিন সাহেব মাসজিদে অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তাদের চাকুরী যাওয়ার উপক্রম হয়। অথচ সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সঠিক খবরটি জিজ্ঞেসকারী ব্যক্তিকে না বলতে পারার জন্য তাদের বুক কাঁপে না। আর এ বিষয়ে আল কুরআন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহিহ হাদিস খোঁজার ব্যাপারেও তারা গাফিল।
সৌদিআরব তথা মাক্কা বা মাদীনায় শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাতের কোনই আমল দেখা যায় না। এমনকি সৌদিআরবসহ মধ্য প্রাচ্যর অন্যান্য দেশের লোকেরা এরূপ নামও শুনে নাই। তাদের দেশে সরকারী ছুটিও নেই এবং সরকার কর্তৃক কোনো ঘোষণাও শোনা যায় না। আর এবিষয়ে আল্লাহই ভালো জানেন।
তবে এ রাত্রির মাহাত্ম্য অর্জন করতে হলে যে কাজগুলো এ রাতসহ পুরো শাবান মাসে করা যেতে পারে, তাহলো- নফল নামাজ, জিকির-আজকার, তেলোওয়াত, ইলম চর্চা, দু‘আ ইত্যাদি। তবে তা একাকী করাই উত্তম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ রাতের কোনো নির্দিষ্ট নামাজ বা অন্যকোনো নির্দিষ্ট ইবাদত নেই। যেমনটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ রাত উপলক্ষ্যে জামাতের সাথে বিশেষ ধরনের নামাজ আদায় করা, কিংবা অনিবার্য মনে করে মিলাদ মাহফিল করা বা মিষ্টি-হালুয়া ইত্যাদি বিরতণ, কিংবা ভাগ্য রজনী মনে করে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে এ নিয়্যাতে এ রাতে রকমারী সুস্বাদু খাদ্য ব্যঞ্জনা খাওয়া, মসজিদ-মাজার ইত্যাদি আলোকসজ্জিত করা, ঈদ উৎসবের আমেজ নিয়ে আড়ম্বতাপূর্ণ পরিবেশে একত্রিত হওয়া, এ রাতকে লাইলাতুল কদরের সমপর্যায়ে নিয়ে প্রাপ্তির চেয়ে অধিক প্রদান করা এগুলো সবই হচ্ছে বাড়াবাড়ি।
পরের দিন রোজা রাখা যাবে কিনা? প্রথম কথা হলো- রাসূল (স.) শাবান মাসের বেশির ভাগই রোজা রাখতেন।
হযরত উসামাহ বিন যাইদ থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূল স. কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, শাবান মাসে আপনি যে পরিমাণ রোজা রাখেন, আপনাকে অন্য কোন মাসে এত রোজা রাখতে দেখিনা। তখন রাসূল (স.) বললেন, রজব এবং রমাদানের মধ্যে অবস্থিত শাবান সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই উদাসীন। তাছাড়া, এ মাসে মানুষের আমলগুলো আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়, তাই আমি চাই রোজাদার অবস্থায় যেন আমার আমলগুলো আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়”।
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত আল কুরআন ও হাদিস গ্রন্থ হতে সংকলিত। দ্বীন প্রচারের স্বার্থে অন্যান্যদের নিকট শেয়ার করুন।] IFM desk