আগামী নির্বাচন, সম্ভাব্য রাজনৈতিক মেরুকরণ, মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জামায়াতের ভূমিকাসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। ১৩ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর হেড অব রিপোর্টিং টিপু সুলতান ও বিশেষ প্রতিনিধি সেলিম জাহিদ।
সাক্ষাৎকারটি আজ রোববার প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
প্রথম আলো: বিএনপি এ বছরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইছে। জামায়াত কি চায়?
শফিকুর রহমান: বিএনপি তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবি জানিয়েছে। তারা গত বছরের আগস্ট মাসের ৬ তারিখ দাবি জানিয়েছিল যে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন চাই। এরপর তারা দাবি জানিয়েছিল ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন। পরে তারা দাবি জানিয়েছিল, ৫ আগস্ট, ২০২৫–এর মধ্যে নির্বাচন চাই। এখন তারা বলছে, জরুরি সংস্কার সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন চাই। আবার তাদের কেউ কেউ বলছেন যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাই। বিএনপি আগে একটা জায়গা ঠিক করলে জাতির জন্য ভালো হয়। আমরা তো ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাচ্ছি।
প্রথম আলো: আপনারা কী চাইছেন?
শফিকুর রহমান: আমরা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ দিইনি। মিডিয়ার সামনে এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় কথা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা একটা আন্দাজ দিয়েছেন, এ বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের প্রথমার্ধে। আমরা বলেছি, এটাকে আমরা অযৌক্তিক সময় মনে করি না, এটা হতে পারে। তবে অবশ্যই সময় কাটানোর জন্য এ সময়টা নয়। যৌক্তিক সংস্কারের যে বিষয়, সংস্কার যদি এর আগেও শেষ হতে পারে, যেকোনো সময় নির্বাচন হলে আমাদের আপত্তি নেই।
প্রথম আলো: আপনি সেদিন সিলেটে বলেছেন, মৌলিক কিছু সংস্কার করা না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটা ‘নির্বাচনের জেনোসাইড’ হবে। আপনারা এটা চান না।
শফিকুর রহমান: রাইট। আমরা বলছি, বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজমান, এই অবস্থায় যদি নির্বাচন হয়, তাহলে এটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না এবং এটা নির্বাচনের জেনোসাইড হবে।
প্রথম আলো: কী আশঙ্কা থেকে এ কথাটা বলছেন?
শফিকুর রহমান: আশঙ্কা হচ্ছে, এখনো আমাদের বহু জায়গায় সংস্কার যেগুলো হওয়ার কথা—যেমন আমাদের ভোটার তালিকা এখনো তৈরি হয়নি, হালনাগাদ হয়নি। যাঁরা বিগত ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বা যাঁদের বয়স পরে ম্যাচিউরড হয়েছে, তাঁদের বিষয়টা এখনো কমপ্লিট হয়নি। প্রবাসীরা আমাদের অংশ। এ দেশের উন্নয়নের অংশীদার এবং এ মাটি তাঁদেরও। তাঁদের ভোটটা এখনো নিশ্চিত হয়নি। অল্প কিছু প্রবাসীর ভোট আছে, বাকিদের নেই। আমরা বলেছি যে প্রবাসীদের ভোটও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এবার স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে দেশের ভেতরে ও বাইরে সবাই তো আন্দোলনের অংশীদার ছিলেন। বাইরের তাঁরা ভেতরের চেয়ে কম ঝুঁকি নেননি। অনেকে দেশের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারফর্ম করেছেন।
প্রথম আলো: আপনারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখের কথা বলছেন না। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করছে জামায়াত।
শফিকুর রহমান: এখানে দুটো কথা। একটা হচ্ছে আমাদের ব্যাপারে অপপ্রচার হচ্ছে যে আমরা নির্বাচন চাই না। আমরা নির্বাচন চাই এবং আমাদের প্রস্তুতিও আছে। জাতিকে এই মেসেজটা আমাদের দেওয়া দরকার। দুই নম্বর হচ্ছে, নির্বাচনের ফুল পলিসি এখনো কিন্তু পাকাপোক্ত হয়নি। নির্বাচনের সময় যখন ঘনিয়ে আসবে, তখন অনেক পোলারাইজেশন (মেরুকরণ) হবে। সেই সবকিছু মাথায় নিয়ে এটি হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক তালিকা এবং এই তালিকা অফিশিয়াল নয়।
প্রথম আলো: আপনি সম্প্রতি ফেনীতে এক কর্মসূচিতে বলেছেন, এখন অনেকে আবার জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা শুরু করেছে। তারপরই বলেছেন, ‘আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না, ধৈর্যের পরীক্ষা নিলে আবার বিস্ফোরণ হবে।’ কার উদ্দেশে কথাগুলো বললেন?
শফিকুর রহমান: যারাই এ রকম করবে, যারা অনাকাঙ্ক্ষিত, অসত্য সমালোচনা করবে, তাদের ব্যাপারে আমরাও তখন মুখ খুলতে বাধ্য হব। আমাদের ঝুড়িতেও অনেক কিছু আছে। একটা ধৈর্যশীল দল হিসেবে দেশ ও জাতির স্বার্থে সবকিছু আমরা সব সময় বলি না। বলতে গেলে অনেক কিছু বলার আছে, আমরা তখন বলতে বাধ্য হব। এতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে এবং এর দায় তাদেরই নিতে হবে, যারা এ রকম উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আমাদের বাধ্য করবে তাদের কথার জবাব দিতে।
প্রথম আলো: আমরা দেখছি, সময় যতই নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, ততই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বাড়ছে। আপনারা তো দীর্ঘদিন এক জোটে ছিলেন, একসঙ্গে সরকারেও ছিলেন। দূরত্বের কারণ কী?
শফিকুর রহমান: কোনো দূরত্ব নেই। প্রতিটি দলের নিজস্ব কর্মসূচি ও পলিসি থাকে। সেই পলিসি ও কর্মসূচির দিক থেকে বিভিন্ন দল জনগণের কাছে আসবে, জনগণ বাছবিচার করে দেখবে। শুধু বক্তব্য নয়, বক্তব্যের সঙ্গে প্রতিটি দলের পারফরম্যান্সকেও বিবেচনায় নেবে।
প্রথম আলো: জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে একটা বিষয় আছে যে তারা জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সহযোগিতা পায়নি।
শফিকুর রহমান: তারা (জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল) দফায় দফায় (বাংলাদেশে) এসেছে। আমি জিনিসটা চেক করে দেখলাম, যে সময়টায় তারা পাঁচ বা সাতবার বিভিন্ন টিমে এসেছে, তাদের এখানে তো সমন্বয় করেন ইউএন এনভয় (জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী) যে আছেন, তিনি। ওনার সঙ্গে তো আমাদের রেগুলার যোগাযোগ আছে। আবার আমরা শুনছি যে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতিকে বিভিন্ন সময় তাঁরা পেয়েছেন, তাঁর ইয়ে (সাক্ষাৎকার) নিয়েছে। তারপরও আমাদের পেল না কীভাবে, এটা আমরা বুঝলাম না। আমাদের একটা অফিস আছে। অফিসে এলে তো নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে দেখা হতো। আবার তাদের এনভয় যিনি আছেন, তিনিও যদি আমাদের বলতেন; …এটা কেমনে মিস হয়ে গেল জানি না। হতে পারে, আমরা এতটা খেয়াল করিনি। অথবা হতে পারে তাঁরা আরও সিরিয়াস হলে আমাদের পেতেন। তাঁরা সেটা করেননি।
প্রথম আলো: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যত বেশি সময় নেবে, তত বেশি সমস্যা তৈরি হবে। আপনারা কী দেখেন?
শফিকুর রহমান: ষড়যন্ত্র তো দেশের বিরুদ্ধে অনেক আছে। এখন তারেক সাহেব কী বলেছেন, সেটা উনি ভালো বলতে পারবেন। আমি তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার অধিকার রাখি না। আর মির্জা ফখরুল সাহেব যেটা বলেছেন, যত দিন যাবে সমস্যার সৃষ্টি হবে। এটাও উনি ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। আমরা কী দেখি, আমরা দেখি চব্বিশের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ার পর তারা (আওয়ামী লীগ) এক দিনের জন্যও বিশ্রাম নেয় নাই। দেশকে অস্থির করে তোলার জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেটাকে দেশবাসী সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র মনে করে। অনেকগুলো ঘটনা এবং সব ঘটনা পরে তদন্ত করে দেখা গেছে, এটার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের লোকেরা।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সোচ্চার। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের অবস্থান কী?
শফিকুর রহমান: আমরা তো বহু আগে বলেছি, আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে তারা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তারা একটি ফ্যাসিস্ট দল। ফ্যাসিজমের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। গণতন্ত্রে যারা বিশ্বাস করে, তারা নিজের দেশ শাসন করতে পারে, কিন্তু অন্য দলের জন্য প্রোপার স্পেস দেয়। আওয়ামী লীগ কখনো কোনো দলকে স্পেস দেয়নি। আপনি তিয়াত্তরে দেখেন, কী করেছে। একেবারে পঁচাত্তর পর্যন্ত কাউকেই স্পেস দেয়নি। আবার ’৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় এসেছে, একের বদলে দশটা লাশ ফেলার ঘোষণা সরকারপ্রধান দিয়েছেন।
প্রথম আলো: তাহলে কি নিষিদ্ধই সমাধান?
শফিকুর রহমান: এবার তারা কী করেছে? ছাত্ররা একটা ন্যায্য অধিকার নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। সেই ইস্যু তাঁরা মানলেন, যখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমাদের কথা না, জাতিসংঘের যে রিপোর্টটা প্রকাশ হয়েছে, সেই রিপোর্ট কী বলেছে? অথচ সেদিনও শেখ হাসিনা বলেছেন, আবু সাঈদের ঘটনা সুপার এডিট। এটা কি আবু সাঈদের আত্মার সঙ্গে তামাশা নয়? চাক্ষুষ যারা দেখল, দুনিয়া যা দেখল টেলিভিশনের স্ক্রিনে। আপনি সেটা ডিনাই (অস্বীকার) করছেন। তো এই দল কী চায়। তারা আসলেই রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকতে চায়? নাকি অন্য কিছু চায়। তারাই বলুক সেটা। নিষিদ্ধ তো হলে হবে, থাকলে থাকবে; এটা পরের বিষয়। আগে তারা ঠিক করুক, তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে পারফর্ম করবে কি না।
প্রথম আলো: জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ছিল অগ্রভাগে। তাতে বিভিন্ন সংগঠন, দল-মত ও শ্রেণি-পেশার মানুষও যুক্ত হয়। এতে জামায়াত বা ছাত্রশিবিরের যুক্ততা কতটা ছিল?
শফিকুর রহমান: প্রথম দিকে কোনো দলই সেইভাবে যুক্ত ছিল না। কিন্তু ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ হামলা চালাল, ছেলে-মেয়ে উভয়কে নাজেহাল করল, তার পর থেকে দলগুলো আস্তে আস্তে সম্পৃক্ত হয়। আমরা তখন বিবৃতির মাধ্যমে এ আন্দোলনকে সমর্থন করি। ছাত্রসমাজ যারা আছে (ছাত্রশিবির) তাদের বলি, তোমরা সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে থাকো। তারা দাঁড়িয়েছে। জুলাইয়ের শেষের দিকে যখন একদম বেপরোয়া হয়ে গুলির পর গুলি শুরু হয়ে গেল, তখন আমরা প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই। এর মধ্যে তো দেখলেন আমাদের নিষিদ্ধ করা হলো।
প্রথম আলো: চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। আপনি সম্প্রতি পীরের বাড়িতে গেলেন, আতিথেয়তা নিলেন, যৌথ সংবাদ সম্মেলনও করলেন। এত মিল হলো কী করে। উদ্যোগটি কার তরফ থেকে?
শফিকুর রহমান: চরমোনাই পীরের সঙ্গে জামায়াতের সুসম্পর্ক ছিল না, কিন্তু সম্পর্ক তো ছিল। যাঁরা রাজনীতি করেন, সেটা ইসলামি দল হোক আর অন্য দল হোক, আমরা কিন্তু সবার প্রতি সম্মান রেখে চলার পক্ষে। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি সবচেয়ে সোচ্চার দল হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তারা নির্বাচনের রাজনীতিতে ছিল। কবে, কোথায় নির্বাচন করেছে, সেটাতে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলনেও তারা একাকার ছিল। দেশকে নিয়ে তারাও ভাবে, আমরাও ভাবি, সবাই ভাবে। ইসলামকে নিয়ে তারা কাজ করে, আমরাও করার চেষ্টা করি। এ জায়গায় মূলধারার ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আছে। আমরা শুধু তাদের কাছে যাইনি, সবার সঙ্গে বসেছি। এখানে আগ্রহ উভয়ের।
প্রথম আলো: ইসলামি দলগুলোর ভোট ‘এক বাক্সে’ ফেলার কথা বলেছেন। সে রকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
শফিকুর রহমান: সম্ভাবনা তো অবশ্যই আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
প্রথম আলো: পীরের বাড়িতে যাওয়ার পর আলোচনা আছে যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনী ঐক্যে যেতে পারে।
শফিকুর রহমান: দেশ এবং দ্বীনের স্বার্থে যা দরকার, আমরা তা–ই করব ইনশা আল্লাহ।
প্রথম আলো: বিএনপিও এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছে, বিভিন্ন ইসলামি দলের সঙ্গে বসছে।
শফিকুর রহমান: আমরা কী বলতে পারব যে আপনাদের (ইসলামি দলগুলো) কাছে আর কেউ যাতে না আসে।
প্রথম আলো: এতে ইসলামি দলগুলোতে একটা দোটানা অবস্থা তৈরি হচ্ছে কি?
শফিকুর রহমান: আমি তা মনে করি না। কারণ, সবাইকে আমি যথেষ্ট ইন্টেলিজেন্ট মনে করি, ম্যাচিউরড মনে করি। সবাই সবকিছু দেখে, চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রত্যাশিত। বিএনপি তো আমাদের সঙ্গেও বসে, সমস্যা কী।
প্রথম আলো: এখন তো বসে না।
শফিকুর রহমান: প্রতিদিন তো আর বসবে না, কিন্তু বসে তো। আবার যখন প্রয়োজন হবে, আমরা বসতে পারি না? আমরা বসি তো।
প্রথম আলো: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা নতুন দল গঠন করছে। এ বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
শফিকুর রহমান: আসলে দলটা তো আর ছাত্ররা করবে না, দল করবে ছাত্রত্ব যাদের শেষ হয়েছে তারা। আর যদি ছাত্ররাও করে তার যদি বয়স হয়, করতেও পারে। আমি নিশ্চিত না। তারা সামনে এলে বোঝা যাবে। একেক পত্রিকা একেক ধরনের বলে, লেখে। দল তারা করতেই পারে। সম্ভবত ৪৯টি দল এখন নিবন্ধিত। বাকি অনেকেই অনিবন্ধিত আছে। আমাদের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার জন্য আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। তো দল নিবন্ধিত কি অনিবন্ধিত কোনো কথা না, রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক দলই। তারা যদি সেই রকম কোনো দল করে দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারে, আমার আপত্তি নেই। এটা জনগণই বিচার করবে। তাদের পারফরম্যান্স দিয়ে তারা প্রমাণ করবে যে তারা কী করতে চায়, কী করতে পেরেছে।
প্রথম আলো: নির্বাচন সামনে রেখে এ রকম একটা আলোচনা হচ্ছে যে জাতীয় নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমঝোতা হতে পারে।
শফিকুর রহমান: অতীতে আমরা (সমঝোতা) বিএনপির সঙ্গে করি নাই? আওয়ামী লীগের সঙ্গে কখনো আমাদের নির্বাচনী সমঝোতা হয় নাই। আমাদের দোষারোপ করা হয় ছিয়াশি ও ছিয়ানব্বই—দুই জায়গায়। ছিয়াশির প্রেক্ষাপট ছিল, তখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় এসে বিএনপির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলের অনেক নেতাকে কনভিকশন দিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। আর ছিয়ানব্বই সালে; আমরা কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে চুরানব্বই সাল থেকে আন্দোলন করি। তখন বিএনপি এটার পক্ষে ছিল না। আওয়ামী লীগ এটাকে আমলে নেয়নি। শেষ দিকে তারা (আওয়ামী লীগ) দেখল যে পাবলিক এটা চায়, তখন তারাও আন্দোলন শুরু করল। জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করে নাই। জামায়াত আগে থেকে যে আন্দোলন করে আসছিল, সে আন্দোলনের ইস্যুকেই আওয়ামী লীগ বাংলা তরজমা করে গ্রহণ করেছিল। আমরা বলেছিলাম কেয়ারটেকার সরকার, তারা বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
অতীতে দেশের স্বার্থেই রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। এখন যদি দেখতে পাই, ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা নতুন দল গঠন করার কথা বলছেন, তাঁদের পারফরম্যান্স, তাঁদের পরিকল্পনা, মনোভাব ভালো কিছু হয়, সমঝোতা হতে পারে। যাদের সঙ্গে আমাদের দলীয় নয়, দেশের স্বার্থ মিলবে, তাদের সঙ্গে ঐক্য বা সমঝোতা করতে আমাদের আপত্তি নেই।
প্রথম আলো: ছয় মাসের বেশি হয়ে গেল অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স। এই সরকারকে আপনি কোন জায়গায় কৃতিত্ব দেবেন, আর কোন জায়গায় ব্যর্থ মনে করেন?
শফিকুর রহমান: ব্যর্থতা, কৃতিত্বের অ্যানালাইসিস আমরা ওইভাবে করি নাই। তবে আমরা দেখছি, এই সরকারকে রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডাররা যদি আরও অর্থবহ সহযোগিতা করতে পারতাম, তাহলে তারা আরও অনেক ইফেক্টিভ হতো। তাদের অনেক কাজেই কিন্তু আমরা অনেকে পদে পদে বাধা দিচ্ছি। পারটিকুলারলি জামায়াতে ইসলামীর কথা বলছি না, রাজনৈতিক পুরো অঙ্গনটাকেই আমি অ্যাড্রেস করছি। এটা না করে যদি তাদের আরও ইতিবাচকভাবে আমরা সহযোগিতা করতে পারতাম, তারা আরও ভালো কিছু করতে পারত।
তবে এত কিছুর পরও তারা যেটুকু নিয়ে এগোচ্ছে, এটাকে আমি একেবারেই হতাশাব্যঞ্জক মনে করি না। বলেন তো কোন দিন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভালো ছিল। কোন সরকার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে আমাদের সময় ‘মব’ হয় নাই। চুরি-ডাকাতি হয় নাই, সর্বকালেই ছিল। এত বড় ডিজাস্টারের পর যদি চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রগুলো না থাকত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও অনেক ভালো হতো। ইকোনমির ব্যাপারটা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। কারণ, ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর ধ্বংস করে গেছে গত সরকার। তার বোঝাটা বর্তমান সরকারের ঘাড়ে পড়েছে। এটাকে সমাধান করে সামনে এগোনো আসলেই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এই জায়গায় যদি দেশবাসী, সব মহলের ইতিবাচক সহযোগিতা থাকে, সময় লাগলেও এখান থেকে উত্তরণ সম্ভব।
প্রথম আলো: ‘মবের’ কথা বলছিলেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের পর ৩৫টির বেশি জেলায় হামলা–ভাঙচুর হয়েছে। পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বিএনপি। আপনিও উসকানিতে পা না দিয়ে ধৈর্য ধরতে ফেসবুকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। দলগতভাবে এই ঘটনাকে জামায়াত কীভাবে দেখে?
শফিকুর রহমান: আমার তিনটা স্ট্যাটাস (ফেসবুক পেজে) এ–সংক্রান্ত আছে, একটু কষ্ট করে দেখে নেবেন।
প্রথম আলো: একটা স্ট্যাটাসের পর অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার সমালোচনা করেন, আক্রমণ করে কথা বলেছেন।
শফিকুর রহমান: আমি বলেছিলাম, এ অবস্থা চলতে থাকলে, এ পাগলামি বন্ধ না হলে দেশে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে। বন্ধ তো হয়ে গেছে। তবে আমার আহ্বানে হয়েছে, তা বলব না। বন্ধ হয়েছে, এটা ভালো লক্ষণ।