গত ২৫ বছরে নীতি নিয়ে অনেক কথা বললেও এখনো টেকসই শাসনব্যবস্থা ঠিক করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বই প্রকাশ সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
‘অ্যাপোসলস অব ডেভেলপমেন্ট: সিক্স ইকোনমিস্টস অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড দে মেইড’ শীর্ষক বই নিয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে বিআইডিএস। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহামান সোবহান। বক্তব্য দেন বইটির লেখক ডেভিড সি এঙ্গারম্যান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক প্রফেসর এ কে এনামুল হক। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান এবং নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়ে গেলেও এখনো আমরা এমন একটি স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে পারিনি, যা জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় কিছু মৌলিক ও সীমিত লক্ষ্য অর্জনই এখন প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, একটি অর্থবহ ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র ছাড়া দেশের উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। এজন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী সংসদ ও সুশাসন নিশ্চিতকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে না পারলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বাজারভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সরে আসা সম্ভব নয়, কিন্তু রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যেন এই বাজারব্যবস্থা ন্যায্যতা ও সামাজিক সমতা রক্ষা করে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ সফল হলে ভবিষ্যতে নীতি নির্ধারণের নতুন অধ্যায় শুরু হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের আদর্শ ও অবস্থান নতুনভাবে নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, কোনো একটি মতবাদের প্রতি পুরোপুরি সমর্পণ—সেটা আর নেই। কে ডান আর কে বাম, তার মধ্যে বিভেদ দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতির সঙ্গে অনেক মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যেমন ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তার সঙ্গে খাপ খাওয়াবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আজ
দক্ষিণ এশিয়ার ছয়জন অর্থনীতিবিদ- বাংলাদেশের রেহমান সোবহান, পাকিস্তানের মাহবুব উল হক, শ্রীলঙ্কার লাল জয়বর্ধনে, ভারতের অমর্ত্য সেন, জগদীশ ভাগবতী ও মনমোহন সিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন তত্ত্বে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছেন। এই বিষয়ে অ্যাপোসলস অব ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক বই লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক ডেভিড সি এঙ্গারম্যান।
যে ছয়জন অর্থনীতিবিদকে নিয়ে বইটি রচিত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক রেহমান সোবহান নিজের বন্ধুদের নিয়ে আলোকপাত করেন। কার চিন্তাধারা কেমন ছিল, তাঁদের মধ্যে কী নিয়ে বিতর্ক হতো, এসব নিয়ে কথা বলেন তিনি।
বরাবরের মতো ন্যায্যতা ও বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন রেহমান সোবহান। বলেন, ‘এমন এক সময় ছিল, যখন অনেকেই মনে করতেন, উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রয়োজন। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য বাজারব্যবস্থার কারণে ছিল না, ছিল রাষ্ট্রীয় কারণে। পাকিস্তান রাষ্ট্রই এই বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। সে কারণে স্বাধীনতার পর জাতীয়করণের প্রয়োজন হয়েছিল। কেননা তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পুঁজি বা পুঁজিপতি ছিল না।’ কিন্তু এত দিন ধরে এত কিছু করার পরও সমাজে বৈষম্য থেকে যাচ্ছে। এর কোনো সংশোধন ঘটছে না বলে আক্ষেপ করেন রেহমান সোবহান। এই বৈষম্য দূর না হলে সমাজে ন্যায্যতা আসবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।