বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪২ অপরাহ্ন




ঐকমত্য কমিশন

গণভোটের সময় নিয়ে মতবিরোধ এখনও মেটেনি

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১১:২৯ am
Vote Ballot Election Vote_Ballot_Election CEC election commission cec ec vote election Electronic Voting Machines evm ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ইভিএম নির্বাচন কমিশন ইসি সিইসি সিইসি ইসি ইভিএম ভোট নির্বাচন জনপ্রতিনিধি ভোটার ভোটগ্রহণ সিইসি রিটার্নিং অফিসার vote ভোট
file pic

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের আয়োজন করার সময় নিয়ে এখনও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। সাত মাস ধরে সংলাপ শেষেও বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তাদের আগের অবস্থানেই রয়েছে। বিএনপি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজনের অবস্থানে অনড়। জামায়াতে ইসলামী আগের মতোই সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে নভেম্বরে গণভোট চায়। আর সাংবিধানিক আদেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এনসিপিও নির্বাচনের আগে গণভোট চায়।

বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংলাপের শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে না পারায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানায়, বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরামর্শ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে সরকারকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

গতকাল বেলা ৩টা থেকে সংলাপ শুরু হয়ে রাত ১১টায় শেষ হয় ঐকমত্য ছাড়াই। এর মাধ্যমে গত মার্চে শুরু হওয়া সংলাপ শেষ হলো। এর আগে গতকাল সকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে পাঁচটি পরামর্শ দেয় বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তবে গণভোট নির্বাচনের আগে, নাকি নির্বাচনের দিন হবে– এ বিষয়ে পরামর্শ দেননি বিশেষজ্ঞরা। এ সিদ্ধান্ত তারা সরকারকে নিতে বলেছেন।

সংলাপের শেষ পর্যায়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বলেন, বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন– ১. সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হবে। ২. আদেশের মাধ্যমে গণভোট হবে। ৩. জুলাই সনদে যেসব সংস্কারে সব দলের ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো নিয়ে একটি প্রশ্ন থাকবে গণভোটে। যে সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন থাকবে গণভোটের ব্যালটে। ৪. গণভোটের মাধ্যমে কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতা (গাঠনিক ক্ষমতা) দিয়ে নির্বাচনে গঠিত আগামী ত্রয়োদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ৫. জুলাই সনদে থাকা সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার পর পরিষদ স্বাভাবিক সংসদে রূপান্তরিত হবে।

বিএনপি সংসদের প্রথম অধিবেশনকে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। আর জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল চায়, প্রথম অধিবেশনেই সংস্কার অনুমোদন করতে হবে।
সংলাপের শেষ দিনে আবেগাপ্লুত হয়ে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাখতে সংস্কার করতে হবে। কমিশন মনে করে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংস্কারে সংসদকে কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতা দিতে হবে। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে কমিশন সরকারকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ করে তা দলগুলোকে অবহিত করবে। এরপর সনদ সই অনুষ্ঠান হবে।

গণভোটে ভিন্নমত রাখতে চায় না কমিশন
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কমিশনই গত মাসে প্রস্তাব করেছিল, নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হবে। তবে গতকালের সংলাপের পর এই অবস্থান পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। কমিশন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টি ফয়সালা করতে গণভোট নির্বাচনের আগে করা উচিত। পিআর উচ্চকক্ষের জন্যই রাজনৈতিক সমঝোতা আটকে রয়েছে। নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া বিএনপি উচ্চকক্ষেও পিআরের ঘোর বিরোধী। এ কারণে জামায়াত, এনসিপি অন্যান্য দলকে রাজি করানো যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞ প্যানেল কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছে, অধ্যাদেশ নয়, সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদ কার্যকর করে গণভোট হবে। সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেও আদেশে বলা থাকবে, এই বিধান এবারের নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হবে না। বিদ্যমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপির আপত্তি থাকলে সাংবিধানিক আদেশের পরিবর্তে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ নাম দেওয়া হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন বিশেষজ্ঞ সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। বৈঠকে একজন বিশেষজ্ঞ সশরীরে এবং চারজন ভার্চুয়ালি যোগ দেন।

জুলাই সনদ সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৯টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার মতো বিষয় রয়েছে।

বিএনপি বলছে, নোট অব ডিসেন্টসহ গণভোট হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জয়ী দলের যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন না করার এখতিয়ার থাকবে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দলের অবস্থান গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট রাখা যাবে না। সংস্কারের ৮৪ প্রস্তাব নিয়ে গণভোট হতে হবে।

ঐকমত্য কমিশন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞরা গণভোটের ব্যালটে একাধিক প্রশ্ন রাখার পরামর্শ দিলেও এই সুপারিশ করা হবে না। কমিশন মনে করে, গণভোটের ব্যালটে জনগণকে প্রশ্ন করা হবে– তারা জুলাই সনদ অনুমোদন করছেন কিনা? একাধিক প্রশ্ন থাকলে বিভ্রান্তি হতে পারে।

বিএনপি আগের অবস্থানেই
সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সাংবিধানিক ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকে আসবে গণভোটের মাধ্যমে। গণভোটে জনগণ যে অনুমোদন দেবে, তা সংসদের ওপর বাধ্যতামূলক হবে। এর মানে এই নয়– ভবিষ্যৎ সংসদ অন্য কোনো সংস্কার করতে পারবে না। তবে জুলাই সনদের ধারাগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
সংসদের প্রথম অধিবেশনকে ‘সংবিধান সংস্কার সভা’র ক্ষমতা দেওয়া এবং প্রথম অধিবেশনেই সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা দিলে জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রস্তাব করেন, ‘যথাসম্ভব শিগগির’ বাক্য উল্লেখ করা যেতে পারে, যাতে সংসদ আইনি প্রক্রিয়ায় সংস্কার সম্পন্ন করতে পারে।

নোট অব ডিসেন্টসহ গণভোটের কথা আবারও বলেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ভিন্নমত সনদের অংশ হিসেবেই গণভোটে যাবে। ভবিষ্যতে কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ সময় তিনি প্রস্তাব দেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে একটি ধারা যুক্ত করা উচিত, যেখানে তারা প্রতিশ্রুতি দেবে– যদি জনগণের ম্যান্ডেট পায়, তাহলে তারা নিজেদের নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমতের বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবে।

নির্বাচনের দিনে গণভোটের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, আলাদা করে গণভোট আয়োজন করা ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও প্রশাসনিকভাবে জটিল হবে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে জনগণ একাধিক ব্যালটে ভোট দিতে পারবে, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়।
আগের মতোই সালাহউদ্দিন বলেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন সম্ভব। গণভোট আইন বা অধ্যাদেশে উল্লেখ থাকবে। সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের আলোচনায় গণভোটের বিধিবিধান নির্ধারণ করা হবে।

সালাহউদ্দিন আহমেদ কমিশনের সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সবাই যে সমঝোতার পথে এগিয়ে এসেছে, তা জাতীয় স্বার্থে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

নভেম্বরে গণভোট চায় জামায়াত
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আমাদের স্পষ্ট অবস্থান, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে। আর নভেম্বরের মধ্যে জুলাই সনদের ওপর গণভোট হবে। গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হলে তা জটিলতা তৈরি করবে। আবার একসঙ্গে আয়োজনের কিছু ভালো দিকও আছে। কিন্তু মন্দ দিক অনেক বেশি। যেমন– পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে কিনা, এ সিদ্ধান্ত নির্বাচনের আগেই হতে হবে। নির্বাচন ও গণভোট এক দিনে হলে কীভাবে উচ্চকক্ষের বিষয়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে।

গণভোটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্যই আগে তা হওয়া উচিত বলে মনে করেন ডা. তাহের। তিনি বলেন, কয়েকটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পরও ফল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। ফলে নির্বাচনে যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে গণভোট নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।

নির্বাচন কমিশনের আলাদাভাবে দুটি নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে কিনা– এ প্রশ্নে জামায়াতের এ নেতা বলেন, ‘গণভোট আয়োজনের খুব বেশি ব্যয় নেই। সময়ও লাগে না। অতীতে ১৯ দিনে গণভোট করার নজির রয়েছে। গণভোট আগে হলে সংসদ নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের কিছু প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’

বিএনপির নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে ডা. তাহের বলেছেন, একটি দলই কিছুটা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। জাতির সামনে তাদের পরিষ্কার করা উচিত, সংস্কার চায় কি চায় না। যেসব দলের যে সংস্কার নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, আগামী সংসদে তাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সে অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। জামায়াতেরও নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। যদি জামায়াতের প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, তাহলে নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে মেনে নেবে, এটাই তো গণতন্ত্র।

এনসিপির অবস্থান বদল, আগে গণভোট চায়
ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপির নেতারা বলেছেন, অধ্যাদেশ নয়, সংবিধানের সমতুল্য আদেশে গণভোটের আয়োজন করা প্রয়োজন তা টেকসই করতে। আদেশের নাম যাই হোক, তারা আপত্তি করবেন না। এনসিপির দাবি ছিল গণপরিষদ। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সমকালকে বলেছেন, সংসদের প্রথম অধিবেশনকে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে গণ্য করলে, আপত্তি নেই।
গত রোববারের সংলাপে এনসিপি প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, নির্বাচনের দিনে গণভোটে আপত্তি নেই। তবে গতকাল সংলাপে তাঁরা জানান, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত থাকায় নির্বাচনের আগে গণভোট প্রয়োজন। আখতার হোসেন সমকালকে বলেছেন, এনসিপি চায় আগে গণভোট হোক। গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট রাখা যাবে না।

ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, তারাও চান নির্বাচনের আগে গণভোট। নোট অব ডিসেন্টমুক্ত হতে হবে গণভোট।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, অবস্থান পরিবর্তন করে কয়েকটি দল আগে গণভোট চাইছে। এভাবে অবস্থান পরিবর্তন শেখ হাসিনাকেই সহায়তা করবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না, সেসব বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তারপর জনগণ ‘থার্ড আম্পায়ার’ হিসেবে গণভোটে রায় দেবে– সিদ্ধান্ত সঠিক, নাকি ভুল হয়েছে।




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD