সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৪৬ অপরাহ্ন




বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কে নতুন গতি

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ ৫:১১ pm
Dhaka-Ankara Dhaka Ankara Turkey President Recep Tayyip Erdoğan তুর্কি ইস্তাম্বুল তুরস্ক প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ তাইয়িপ এরদোয়ান এরদোগান Turkey তুরস্ক
file pic

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কে নতুন গতি পেয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক বা ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) হয়েছে। গত এক বছরে ডজনখানেক সফর বিনিময় হয়েছে ঢাকা ও আঙ্কারার মধ্যে। যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে রাজনৈতিক পরিসরে সম্পর্ক জোরদার, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি থেকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে অংশীদারত্বে রূপ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো। এসব বিষয় বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

‘ডিফেন্স ফ্রেমওয়ার্ক ফর কোঅপারেশন’ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি
বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে বিদ্যমান ছোট ছোট সমঝোতা স্মারকগুলো (এমওইউ) এক ছাতার নিচে আনতে একটি ‘ডিফেন্স ফ্রেমওয়ার্ক ফর কোঅপারেশন’ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে নিশ্চিত করেছে কূটনৈতিক সূত্র। নভেম্বরে সেনাপ্রধানের তুরস্ক সফরে এটা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আঙ্কারা সূত্র জানিয়েছে, গত সপ্তাহেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই ফ্রেমওয়ার্কের খসড়া চূড়ান্ত করে তুরস্কে পাঠানো হয়েছে। দুই বছর আগে তুরস্ক এ চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গতি পেয়েছে সরকার পরিবর্তনের পর। তবে এই ডিফেন্স ফ্রেমওয়ার্ক ফর কোঅপারেশনটি আসন্ন নির্বাচনের পর গঠিত পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গেই চুক্তিটি স্বাক্ষর করার আগ্রহ প্রকাশ করে আঙ্কারা।

গত জুলাই মাসে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান হালুক গরগুন বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে সম্ভাব্য কারিগরি ও কৌশলগত সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।

এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ’হালুক গরগুনের সফরের ফলোআপ হিসেবেই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান নভেম্বরে তুরস্ক যাচ্ছেন। এরমধ্যে ডিফেন্স ফ্রেমওয়ার্ক ফর কোঅপারেশনের বিষয়ে তুরস্ক যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে হয়তো সেনাপ্রধান বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করবেন। তারপর হয়তো আমরা বলতে পারব কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্কের আন্ডারে কোন কোন কোঅপারেশনগুলো আসবে।’

কূটনৈতিক সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার (বিওএফ) সক্ষমতা বাড়াতে তুরস্কের সহায়তায় যৌথ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন নয়, ভবিষ্যতে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিরও সুযোগ তৈরি হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো নীতিগতভাবে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির অনুমতি নেই। তবে এ বিষয়ে রিভিশনের চিন্তা আছে। যদি বাংলাদেশ নিজে অস্ত্র রপ্তানি করে বা এখানে উৎপাদিত অস্ত্র তুরস্ক কিনে বাইরে বিক্রি করে, সেটি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় শক্তি হবে।’

প্রসঙ্গত, তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রতিরক্ষা পণ্য উৎপাদনকারী দেশ। দেশটি ন্যাটো সদস্য হওয়ায় তাদের মান ও প্রযুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চমানসম্পন্ন।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মনে করেন, চীনের তুলনায় তুরস্কের সরঞ্জাম কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও মান, নির্ভরযোগ্যতা ও আফটার-সেল সার্ভিসে তুরস্কের সহায়তা তুলনাহীন।

সম্পর্কে গতির কারণ কী
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ও তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্কের উষ্ণতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর।

এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে দুই দেশের সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক, বলা যায় ঝামেলামুক্ত হলেও বিশেষ ঘনিষ্ঠ নয়। কিন্তু গত এক বছরে দুই দেশের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সফর বিনিময়ে সম্পর্কের গভীরতা স্পষ্টভাবে বেড়েছে।

তার মতে, তুরস্ক এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরাসরি ভূমিকা রাখতে আগ্রহী বলেই আঙ্কারার আচরণে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শপথ নেওয়ার দিনই তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোয়ান শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশি নেত্রী, যিনি নতুন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানান। এরপরের সপ্তাহেই প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজে ফোন করে অভিনন্দন জানান। অক্টোবরে তুরস্ক থেকে একটি রিফর্ম টিম বাংলাদেশ সফর করে বিভিন্ন খাত পর্যালোচনা করে উন্নয়ন সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়, যার পাল্টা হিসেবে বাংলাদেশেরও একটি প্রতিনিধি দল আঙ্কারা সফর করে।

উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সরকারের সময় ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক বেশ কিছু সময়ের জন্য শীতল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হলে বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ে সেই প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে তুরস্ককে সমর্থন জানায়। সেই সময় থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

দায়িত্বশীল কূটনীতিকরা বলছেন, এবারকার উষ্ণতার পেছনে অন্যতম একটি কারণ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দীর্ঘদিনের পেশাগত ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ড. ইউনূস তুরস্কে মাইক্রোক্রেডিট মডেল নিয়ে কাজ করায় আঙ্কারায় তিনি বেশ পরিচিত মুখ। অন্যদিকে, ইসলামিক বিশ্বে একধরনের সমন্বিত নেতৃত্ব গঠনের ধারণা বাস্তবায়নে তুরস্ক আগ্রহী। যেখানে ইসলামিক দেশগুলো পারস্পরিক স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করবে।

এ বিষয়ে আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত সরকারের সময় বাংলাদেশ নিজেকে একটি সেক্যুলার স্টেট হিসেবে তুলে ধরত। ফলে তুরস্কের কাছে মনে হয়েছিল, ঢাকা হয়তো ইসলামিক ব্লকের সহযোগিতা থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আঙ্কারার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এখন তারা মনে করছে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থি দলগুলো কথা বলতে পারে। তুরস্কের ধারণা ছিল যে, আগে ওদের কথা বলতে দেওয়া হতো না।’

এক বছরে উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময়
গত এক বছরে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে একের পর এক উচ্চপর্যায়ের সফর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সফর বিনিময়ের মাত্রা বেড়েছে।

গত বছরের আগস্টের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সফর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রী ওমের বোলাটের ঢাকা সফর। সফরে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন।

এরপর ফেব্রুয়ারিতে আঙ্কারা সফর করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) নজরুল ইসলাম। তিন দিনের সফরে তিনি তুরস্কের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিস একিনচিসহ অর্থ, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এপ্রিলে আনতোলিয়া ডিপ্লোমেসি ফোরামে অংশ নিতে গিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে দুই দেশের অংশীদারত্ব নতুন উচ্চতায় নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়।

গত জুলাইয়ে ঢাকা সফর করেন তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান হালুক গরগুন। একদিনের এ সফরে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। সফরের সময় তিনি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পে প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।

জুলাইয়ে বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তুরস্ক সফর করেন। সেখানে তুরস্কের ফুটবল ফেডারেশন ও এথনিক স্পোর্টস ফেডারেশনের (যার প্রধান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ছেলে বিলাল এরদোয়ান) সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

গত মে ও চলতি অক্টোবরে তুরস্ক সফর করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এ মাসেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনও তুরস্ক সফরে যান।

গত ৬ অক্টোবর ঢাকায় আসেন তুরস্কের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বেরিস একিন্চি। প্রায় ছয় বছর পরে দু’দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বা ফরেন অফিস কনসাল্টেশনে (এফওসি) নেতৃত্ব দেন তিনি।

নভেম্বরে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তুরস্ক যাওয়ার কথা রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক না হলেও সফরকালে দেশটির উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা চলছে।

তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়া নিয়ে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আমানুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ-তুরস্ক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দ্রুতগতিতে ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে। গত এক বছরের বেশি সময়ে ‍গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সফর বিনিময় হয়েছে।’

‘দীর্ঘ ছয় বছর পর দু’দেশের মধ্যে এফওসি অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এটাকে আমরা এফওসি না বলে পলিটিক্যাল কনসালটেশন বলছি। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তুরস্ক সরকারের আস্থা এবং ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার ইচ্ছার প্রতিফলন পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর ওপর কাজ করার দিকনির্দেশনা মিলেছে। বিশেষ করে ডিফেন্স কোঅপারেশন, যেখানে ভিজিট ও আলোচনা অব্যাহত থাকবে,” বলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

‘পাশাপাশি বাংলাদেশ-তুরস্ক যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের মিটিং আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে, যা দুই দেশের ট্রেড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে,’ বলেন তিনি।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত শফিউল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরা রাজনৈতিকভাবে অনেক সামনে চলে এসেছে। ফলে এই সুযোগ নিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় তুরস্ক। দেশটি ন্যাটোর সদস্য এবং ওআইসিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তুরস্কের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক।’ জাগো নিউজ




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD