রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি পণ্য মজুত রাখার কার্গো ভিলেজে শনিবার (১৮ অক্টোবর) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর দুদিন আগে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) আগুন লেগে পুড়ে গেছে একটি পোশাককারখানা ভবন। পরপর ঘটা এসব অগ্নিকাণ্ড কেবল কাকতালীয় নয়, বরং এতে নাশকতার আঁচ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভয়াবহ আগুনে পুড়লো হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ। ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়েছে কার্গো ভিলেজের আমদানি করা পণ্য রাখার এলাকা। অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিমানবন্দরের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখায় আটকা পড়েন শত শত যাত্রী। ঢাকামুখী অনেক ফ্লাইট সিলেট, চট্টগ্রাম ও কলকাতায় অবতরণ করে। বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর স্থানে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা- নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে নানা মহল থেকে। প্রশ্ন উঠেছে এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের তরফেও বলা হয়েছে, এ ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ পাওয়া গেলে দৃঢ় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এত বড় আগুন অস্বাভাবিক
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান বলেন, দফায় দফায় এমন বড় অগ্নিকাণ্ড কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি কেপিআইভুক্ত (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) এলাকা, যেখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকার কথা। সেখানে আগুন লাগলেও এতক্ষণ ধরে জ্বলার কথা নয়। বিমানবন্দরের ভেতরেই ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ইউনিট রয়েছে। তারা সাধারণত বিমানের আগুন নেভাতে সক্ষম। এত শক্তিশালী ইউনিট থাকা সত্ত্বেও আগুন নিয়ন্ত্রণে এতটা সময় নেওয়া কর্তৃপক্ষের গাফিলতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
আলী আহম্মেদের মতে, এ ঘটনাগুলোর দ্রুত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কেন আগুন লাগলো, কীভাবে লাগলো এবং আগুন নেভাতে বিলম্ব হলো কেন- তা স্পষ্টভাবে জানতে হবে। কারণ এসব আগুন দেশের ভাবমূর্তি ও অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করার ইঙ্গিত হতে পারে।
বিমানবন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কার্গো ভিলেজ। যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়। আবার বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যও সেখানে রাখা হয়। কিন্তু এ রকম একটি জায়গায় আগুন লাগার পর সেটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে সেখানকার অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টি সামনে এসেছে। প্রাথমিকভাবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ক্ষয়ক্ষতির পরিমান জানাতে না পারলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি হবে। রাজনৈতিক নেতারাও ঘনঘন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে নাশকতা হিসেবে দেখছেন। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কয়েজন কর্মী ও ২৫ জনের মতো আনসার সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কাস্টমস এজেন্টের নেতারা বলেছেন, কার্গো ভিলেজের যে অংশে কুরিয়ারের গুদাম থাকে সেই অংশ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম ভূঁইয়া মিঠুর ভাষ্য, শনিবার সরকারি ছুটির দিনে দুপুর ২টা পর্যন্ত কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম চলে। সেখানে তখনো অনেক শ্রমিক ও আনসারসহ লোকজন ছিলেন। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয়, এই গুদামে রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে; সবাই সরে যান। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা কাজকর্ম চলে। এ কারণে এক শিফটের কর্মীরা আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী শিফটে যাদের আসার কথা ছিল, তাদের অনেকে তখনও ঢোকেননি। আবার সারা দিনের শিফটে যাদের কাজ করার কথা ছিল, তাদের তখন দুপুরের খাবারের বিরতি চলছিল। এ কারণে আগুন লাগার সময় সেখানে এয়ারলাইন্স ও এজেন্টদের কর্মী কম ছিল।
মিঠু বলেন, কুরিয়ার গুদামের একপাশে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। তিনি দাবি করেন, আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর ফটকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিলেন না। মিঠু বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়লাম। আমদানি করা সব মূল্যবান মালামাল পুড়ে গেছে। কার্গো ব্যবস্থাপনা এখন অচল প্রায়। যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, আমাদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কার্গোর নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, স্কাই ক্যাপিটালের গুদাম থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়। সেখানে কেমিক্যাল থাকার কারণে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, কার্গোর ৩ নম্বর গুদাম, কার্গো ভিলেজ পুড়ে গেছে। আগুনের তীব্রতা ও ভয়াবহতা অনেক বেশি। স্মরণকালের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। গার্মেন্টস পণ্য, ওষুধ, কেমিক্যাল, টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতিসহ মূল্যবান আমদানি করা মালামাল পুড়ে গেছে। পুরো কার্গো অচল। এটি ঠিক করতে সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এটি কীভাবে পূরণ হবে- তা বলা সম্ভব নয়।
থাকতে পারে নাশকতার আলামত
ফায়ার সার্ভিসের আরেক সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শহিদউল্লাহ বলেন, ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার আলামত থাকতে পারে। শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন নেভানোর সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক। সম্প্রতি যেভাবে একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, তাতে দেশের অর্থনীতি দুর্বল করার কোনো পাঁয়তারা চলছে কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। দুর্ঘটনার আড়ালে নাশকতা লুকিয়ে থাকতে পারে।
ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা
আবু নাঈম জানান, আগুন লাগার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ফায়ার অ্যালার্ম ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সমন্বয়- সবকিছুই ব্যবস্থাপনার অংশ। সেখানেই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। বিমানবন্দরের মতো জায়গায় প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি থাকা উচিত নয়। ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ মহড়া নিয়মিত হচ্ছে কি না, সেটি দেখা দরকার। কারণ এমন জায়গায় কোনো অনুশীলন না হলে বিপদের সময় সমন্বয় ভেঙে পড়ে।
জরুরি স্বচ্ছ তদন্তের দাবি
দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পরপর আগুন লাগার ঘটনায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত। কে বা কারা এসব ঘটনার পেছনে জড়িত, কিংবা এটি নিছক দুর্ঘটনা কি না তা জানতে না পারলে এমন অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সাবেক এ দুই ডিজি।
শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলে রওনা হয়। পরে আগুন ছড়াতে থাকলে ইউনিটের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানিয়েছেন, ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, অগ্নিনির্বাপণে কাজ করছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিটসহ নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী।
সেই সঙ্গে বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনুমানিক এক হাজার আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছেন। বিজিবির দুই প্লাটুন সদস্যও কাজ করছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে সিইপিজেডের অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিকেল কোম্পানির গুদামে ভয়াবহ আগুন লাগে। প্রায় সাড়ে ১৭ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। অ্যাডামস তোয়ালে ও ক্যাপ এবং জিহং মেডিকেল সার্জিক্যাল গাউন তৈরির কারখানা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, আগুন লাগা সাততলা ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ভবনের দুই পাশ দিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ পাওয়া যায়নি। অন্য দুই পাশ থেকে চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ভবনের আশপাশে যে ন্যূনতম জায়গা রাখতে হয়, সেটি দুই দিকে ছিল না।