নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরেশোরে এগিয়ে নেওয়ার দাবি করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতির কথা বরাবরই বলছে তারা। তবে এই প্রস্তুতিপর্বেই নানা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন দাবি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে গত বুধবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ইসির কয়েকটি কার্যক্রমে ধীরগতি থাকায় এই সময়ের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল ঘোষণার কথা। গত ২৮ আগস্ট নির্বাচনী পথরেখা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করে ইসি। এতে আইন ও বিধির সংশোধন, অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করা এবং নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটাসহ ২৪টি কার্যক্রম প্রাধান্য পায়। রোডম্যাপে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কার্যক্রমের অগ্রগতি তেমন নেই।
আরপিও সংশোধন নিয়ে নানা প্রশ্ন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী অধ্যাদেশ গত বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে রাষ্ট্রপতি সই করলে এই সংশোধনী কার্যকর হবে।
তবে আরপিওর কয়েকটি সংশোধন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে জোটবদ্ধ হলেও সব দলকে নিজ প্রতীকে ভোট করার বিধান নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা এরই মধ্যে এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপি আগের বিধান বহাল রাখার দাবি জানিয়ে ইসি ও আইন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল সংশোধিত বিধান বহাল রাখার পক্ষে। এ ছাড়া আরপিওতে অস্বাভাবিক হারে জামানত বৃদ্ধির বিষয়েও নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে অনেক দলের।
এদিকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ ধরে সংসদ নির্বাচনে দল ও প্রার্থীর আচরণবিধির গেজেট প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। নির্বাচনী প্রচারণায় পোস্টারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করাসহ কয়েকটি নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তবে পোস্টার ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছে কয়েকটি দল।
প্রবাসীদের ভোটদান বিষয়ে প্রস্তুতি ধীর
প্রথমবারের মতো পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগ দিতে ভোটার নিবন্ধন ও এনআইডি কার্যক্রম শুরু করেছে ইসি। আগামী নির্বাচনে অন্তত ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটার পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট দেবেন– এমন পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। এর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। তবে এই প্রকল্পে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে। গত দুই বছরে ১০টি দেশের মাত্র ৫৫ হাজার প্রবাসীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ শেষ করেছে ইসি। নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩০ হাজারের বেশি প্রবাসী। মাত্র ১৫ হাজার ৮৭৭ জন ভোটার হয়েছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়েছেন ১৩ হাজার ৯৯০ জন।
ভোট গ্রহণের আগে চার মাসে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর ভোট দেওয়া নিশ্চিত করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই। প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্বাচনী অ্যাপ চালু এখনও সম্ভব হয়নি। যদিও আগামী ১৬ নভেম্বর এই অ্যাপের উদ্বোধন করা হবে বলে ইসি থেকে জানানো হয়েছে। ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। সে কারণে ইসি দ্রুতগতিতে কাজ শেষ করতে পদক্ষেপ নেবে।
সীমানা নির্ধারণে জটিলতা
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রমের শুরুতেই ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রশ্নের মুখে পড়ে ইসি। নানা প্রক্রিয়া শেষে গত ৪ সেপ্টেম্বর ১৬টি জেলার ৪৬টি আসনে রদবদল করে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করে তারা। এতে গাজীপুর জেলায় পাঁচটি আসন থেকে একটি বাড়িয়ে ছয়টি এবং বাগেরহাটের চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে তিনটি করা হয়।
তবে পুনর্নির্ধারিত সীমানা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও সহিংসতার পাশাপাশি অন্তত ২০টি আসনের সীমানা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে ২৭টি রিট আবেদন হয়েছে। ফলে তপশিল ঘোষণার আগেই এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে ইসিকে।
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘ইসি সবগুলো রিটের বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আশা করছি, রিটের কারণে নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না।’
নতুন দল নিবন্ধনসহ আটকে আছে অনেক কিছু
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন নিয়েও ইসির কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সেই সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ‘শাপলা’ প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েও সংকটে পড়েছে তারা। রোডম্যাপ অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রমের শেষ দিন ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। সেদিন ১৫টি দলের নাম প্রকাশ করে ইসি জানায়, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরও ১০টি দলের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করা হবে। তবে অধিকতর তদন্তে ইসির পদক্ষেপে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে নিবন্ধনপ্রত্যাশী কয়েকটি দল। তারা দ্রুত নিবন্ধনের দাবিও তুলেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) নিবন্ধনের প্রাথমিক তালিকায় রাখার বিষয়টিও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ইসির তদন্ত কর্মকর্তারাই প্রতিবেদন দিয়েছেন, দল দুটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ‘অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা’ নেই। নিষ্ক্রিয় দল দুটিকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রাখায় বিস্মিত অনেকেই।
গত মার্চে শুরু করে সাড়ে সাত মাসেও নতুন দল নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি ইসি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও শুরু করতে পারছে না তারা। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েকটি ধাপে অন্য অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ শেষ হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। যদিও ইসি থেকেই বলা হয়েছিল– অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ হবে।
এ ছাড়া নির্বাচনের প্রধান অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ এবং তাদের মতামত ছাড়াই ইসি আরপিওসহ গুরুত্বপূর্ণ আইনবিধি সংশোধনের কাজ শেষ করায় ক্ষুব্ধ দলগুলো। এটা নির্বাচনের মাঠে আরেকটা জটিলতা সৃষ্টি করবে বলেও শঙ্কা রয়েছে।
পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা
দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়েও জটিলতার মুখে পড়েছে ইসি। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিবন্ধনযোগ্য ৭৩টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার তালিকা প্রকাশ করে তারা। এরপরই জানা যায়, এসব সংস্থার অনেকগুলোই নামসর্বস্ব। সেগুলোর অফিস বাসা-বাড়ি কিংবা পরিত্যক্ত ঘরে। এ নিয়ে বিতর্ক ওঠায় পর্যবেক্ষক সংস্থার চূড়ান্ত নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবছে কমিশন। ইসি সচিব আখতার আহমেদ অবশ্য চলতি সপ্তাহের মধ্যেই রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিশেষত ‘মব সন্ত্রাস’ ভোটের পরিবেশকে বিঘ্নিত করবে বলে শঙ্কা রয়েছে। গত ২০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে ইসির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় আসে। তবে সশস্ত্র বাহিনীসহ সবগুলো বাহিনীই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভোটের আগে-পরের আট দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে আট লাখ সদস্য দায়িত্বে থাকবেন।
ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে। বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাসদস্যদের ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছে ইসি।
নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা সংস্থা ও প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ভোটের পরিবেশ আরও ভালো হবে বলে আশা করছেন তারা। এ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।
ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে ভিন্নমত
ভোটের দায়িত্ব পালন করবেন সাড়ে ১০ লাখের বেশি কর্মকর্তা। যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করার প্রচেষ্টা চলছে ইসির। কিন্তু ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা প্যানেল নির্ধারণ কার্যক্রম নিয়ে বেশ চাপে আছে তারা।
গত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বিতর্কিত কর্মকর্তাদের আগামী ভোটে দায়িত্ব না দিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ বেশির ভাগ দল দাবি জানিয়েছে। বিএনপি ইসিতে চিঠি দিয়ে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ভোটের দায়িত্বে না রাখার দাবি তুলেছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা অবশ্য ইসিতে গিয়ে বিএনপির এমন দাবির কঠোর সমালোচনা করে এসেছেন।
অগ্রগতিও আছে নানা ক্ষেত্রে
নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের মধ্যে ইসির নির্বাচনী প্রস্তুতির বিভিন্ন কাজে অগ্রগতিও আছে। বিশেষ করে আইন ও বিধি সংস্কার, ভোটের সরঞ্জাম কেনা, ভোটকেন্দ্র চূড়ান্তকরণ এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শেষ হয়েছে। রোডম্যাপের বাকি কার্যক্রমগুলো ভোটের তপশিলের আগে-পরে শেষ হবে বলেও আশাবাদী ইসি কর্মকর্তারা।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য সবধরনের প্রস্তুতি চলছে। আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক রদবদল, রিটার্নিং অফিসার ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগসহ সব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সবমিলিয়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য যা যা দরকার, আমরা পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। প্রস্তুতির দিক থেকে আমরা সামান্য পিছিয়ে আছি। তবে আতঙ্কিত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার মতো কোনো কারণ বা পরিস্থিতি নেই।’ সমকাল