মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) কোম্পানি, ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি)’র মধ্যে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে দেশের বৃহত্তম এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ এ ব্যবস্থায় যুক্ত হতে তিন মাস সময় চেয়েছে। অন্যদিকে আরেক এমএফএস প্রতিষ্ঠান নগদকে এখনও এ প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইন্টারঅপারেবল/আন্তঃলেনদেন চালুর জন্য কারিগরি ও অর্থ স্থানান্তরের চার্জ নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব বৈঠক হয়েছে সেখানে অন্যদের সঙ্গে বিকাশ এবং নগদের প্রতিনিধিরা ছিলেন। সব প্রতিষ্ঠানের মতামত নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর সার্কুলার দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ব্যাংক, এমএফএস এবং পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের মধ্যে ইন্টারঅপারেবল লেনদেন চালুর জন্য ১ নভেম্বর তারিখ ঘোষণা করে। তবে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নগদকে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। আর অনুমোদন পেলেও গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ ব্যাংককে বিকাশ জানিয়েছে, এই মুহূর্তে তারা প্রস্তুত নয়। ফলে দেশের সবচেয়ে বড় দুই এমএফএস প্রতিষ্ঠান আন্তঃলেনদেন সেবার বাইরে থাকল।
জানা গেছে, ইন্টারঅপারেবল সিস্টেমে প্রাথমিকভাবে ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স না পাওয়ায় নগদকে শেষ পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এরপর বিকাশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রকেট ও ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ, দুটি পিএসপি এবং ১১টি ব্যাংককে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিকাশ থেকে ই-মেইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়, এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের সময় দরকার। তবে এ বিষয়ে বিকাশকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিকাশ ও নগদকে বাদ দিয়ে ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গতকাল এই সেবা চালু হয়েছে। আরও ৫টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, বিকাশ জানিয়েছে, আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থার জন্য তাদের সিস্টেম এখনও পুরোপুরিভাবে নিরাপদ নয়। যে কারণে তিন মাস সময় চেয়েছে। তিনি বলেন, নগদের বিষয়ে পরে জানানো হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক আগ এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংক, ব্যাংকের সঙ্গে এমএফএস ও পিএসপির মধ্যে লেনদেন করা যায়। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশের (এনপিএসবি) আওতায় বিকাশ, নগদ, রকেট এবং এম ক্যাশের মধ্যে ইন্টারঅপারেবল ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি একেবারে নতুন। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত তাতে সফল হয়নি।
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, বিকাশ শুরু থেকেই বাংলাদেশে ব্যাংকের আন্তঃলেনদেন সেবা চালুর উদ্যাগের সঙ্গে যুক্ত আছে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এ সেবার সর্বশেষ সংস্করণে যুক্ত হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে আন্তঃলেনদেনের কার্যকারিতা এ ব্যবস্থায় সংযুক্ত অন্যান্য অংশীজনের ওপরও নির্ভর করে। তাই এই মুহূর্তে বিকাশ শক্তিশালী অথেন্টিকেশন এবং স্তরভিত্তিক (লেয়ারড) নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে লেনদেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং এ সংক্রান্ত কোনো বিরোধ (ডিসপিউট) দেখা দিলে তা সমাধান করা যায়। সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর খুব দ্রুতই গ্রাহকরা পূর্ণাঙ্গভাবে এ সেবা ব্যবহার করতে পারবেন বলে তারা আশা করছেন।
নগদের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রাহকসেবা বৃদ্ধির জন্য মাস দুয়েক আগে নগদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আন্তঃসংযোগ সেবা চালুর অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে। তবে এখন পর্যন্ত সেই আবেদনের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে প্রস্তুতি থাকার পরও নগদের পক্ষে এখনও আন্তঃসংযোগ সেবা চালু করা সম্ভব হয়নি। অনুমোদন পেলেই দ্রুততার সঙ্গে নগদ এ সেবা চালু করবে। নগদ আন্তঃসংযোগ সেবা চালু করলে তা দেশের ক্যাশলেস যাত্রাকে বেগবান করবে।
কত টাকা চার্জ
আন্তঃলেনদেনে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ব্যাংক, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার এবং এমএফএস তার গ্রাহক থেকে সর্বোচ্চ কত টাকা চার্জ নিতে পারবে তা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে চাইলেই একটি প্রতিষ্ঠান আর আগের মতো চার্জ নিতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত চার্জ অনুযায়ী এক এমএফএস থেকে আরেক এমএফএসে টাকা পাঠাতে স্থানান্তরিত অর্থের ওপর সর্বোচ্চ 0.৮৫ শতাংশ তথা প্রতি হাজারে সাড়ে ৮ টাকা চার্জ নেওয়া যাবে। পিএসপি নিতে পারবে প্রতি হাজারে দুই টাকা এবং ব্যাংক পাবে দেড় টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম যাচাই করে ইন্টারঅপারেবলে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। তবে নির্ধারিত চার্জ নিয়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আপত্তি জানায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে প্রতিষ্ঠান বিশেষের স্বার্থ না দেখে বাস্তবতার নিরিখে চার্জ ঠিক করা হয়েছে।
আগের উদ্যোগ আটকে যায় যেভাবে
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবরে ইন্টারঅপারেবল সিস্টেম চালুর ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এর আগের দিন ২৬ অক্টোবর এক নির্দেশনার মাধ্যমে বলা হয়, আপাতত এ ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। এরপর ২০২২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পৃক্ততায় ‘বিনিময়’ নামে একটি আন্তঃলেনদেন প্ল্যাটফর্ম চালু হয়। সেখানে বিকাশ, রকেট ও এম ক্যাশ ছাড়াও ‘টালি পে’ নামের একটি পিএসপি এবং সোনালী, ব্র্যাক, ইউসিবি, ইস্টার্ন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ও মিডল্যান্ড ব্যাংককে যুক্ত হয়। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিপত্তি বাধে। জানা যায়, বিনিময় প্ল্যাটফর্মের প্রকৃত মালিক যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত পাঁচটি শেল কোম্পানি। যার পেছনে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়। ফলে সরকার পতনের পর থেকে প্ল্যাটফর্মটি বন্ধ হয়ে যায়। সমকাল