বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪২ অপরাহ্ন




হাসিনার ফাঁসির রায়ে আটলান্টিক কাউন্সিলের বিশ্লেষণ

হাসিনার ফাঁসির রায়ে আটলান্টিক কাউন্সিলের বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের নির্বাচন: দিল্লির কৌশলও বদলাচ্ছে

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫ ৭:৫৬ pm
Vote Ballot Election Vote_Ballot_Election CEC election commission cec ec vote election Electronic Voting Machines evm ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ইভিএম নির্বাচন কমিশন ইসি সিইসি সিইসি ইসি ইভিএম ভোট নির্বাচন জনপ্রতিনিধি ভোটার ভোটগ্রহণ সিইসি রিটার্নিং অফিসার vote ভোট
file pic

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গতবছরে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের দায়ে বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর দেশটি এক নতুন ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। গত বছর সরকার অপসারণের পর হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই অবস্থান করছেন। সম্প্রসারিত আইসিটি আইনের আওতায় তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। এই রায়কে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে ব্যাপক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি কীভাবে বাংলাদেশের আগামী পথকে প্রভাবিত করতে পারে- তা ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও আঞ্চলিক কূটনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। এই রায় একদিকে আন্দোলনে নিহতদের জন্য স্বীকৃতি ও জবাবদিহির প্রতীক, অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক বিভাজন, নির্বাচনপূর্ব উত্তেজনা এবং ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। দেশটি কোন পথে যাত্রা করবে- তা নির্ধারণ করবে আগামী মাসগুলো, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।

অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নমেন্ট বিভাগের ভিজিটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রুদাবেহ শাহিদ মনে করেন, এই রায় দেশের দীর্ঘ ও অস্থির রাজনৈতিক যাত্রাপথে এক নির্ধারক মোড় নির্দেশ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যদিও রায়টি সরাসরি হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র দমনের অভিযোগকে কেন্দ্র করে, কিন্তু জনমতকে বোঝা যাবে না যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতীত ভূমিকা ও বিতর্কিত ধারণার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নেয়া হয়। পূর্ববর্তী সরকার আমলে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিচারের সময় যে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছিল- তা আজকের রায়কে জনসংগঠনগুলো কীভাবে দেখছে, তাতে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছে।

শাহিদ এক শক্তিশালী প্রজন্মগত বৈপরীত্য তুলে ধরেন। এক দশক আগে শাহবাগে তরুণ মিলেনিয়ালরা যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দাবিতে লাখো মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন। আজ, নতুন প্রজন্ম জেনারেশন জেড অন্য এক মুহূর্তের মুখোমুখি- এরা হাসিনার রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন তাদের সেই সহপাঠী ও বন্ধুদের স্মরণ করে, যারা জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। তবে এদের বড় অংশ মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে বলে নয়- বরং তারা বহুদিনের দায়বদ্ধতার দাবি পূরণ হয়েছে বলে মনে করছেন।

তিনি আরও বলেন, হাসিনাকে ভারতে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। কারণ দিল্লি ইতিমধ্যেই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে দুই পরিবারের রাজনৈতিক সখ্য ভারতকে এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক করে তুলেছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গন একপাক্ষিক হয়ে পড়তে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। শাহিদের মতে, রায়টি বাংলাদেশের মানুষকে দুটি বিস্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাগ করে দিয়েছে। এক পক্ষ মনে করে এটি দীর্ঘদিনের জবাবদিহির স্বীকৃতি, আর অন্য পক্ষ পুনর্মিলনের পথে বাধা দেখছে। কোন দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক এবং ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের সাউথ এশিয়া ব্রীফ-এর লেখক মাইকেল কুগেলম্যান রায়টির প্রভাব মূলত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন। তার মতে, হাসিনার ভারতে অবস্থান দিল্লিকে এক অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। একদিকে হাসিনা ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র এবং ভারতীয় শাসক দল থেকে বিরোধী দল পর্যন্ত বহু নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অপরিহার্য। কারণ বাণিজ্য, সীমান্ত নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার মতো স্বার্থগুলো ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কুগেলম্যান মনে করেন, ভারত হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করবে না, তবে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতেই রাখা ভারত-বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তার মতে, দিল্লির সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বিকল্প হলো হাসিনাকে কোনো তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা- এমন কোনো দেশ যেখানে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে এবং তার রাজনৈতিক কার্যকলাপও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পূর্ব ইউরোপ থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নাম আলোচনায় এসেছে। তবে কোনো দেশই এত উচ্চ-প্রোফাইল একজন নেতাকে আশ্রয় দিতে আগ্রহী হবে কিনা সেটি অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, ভারতের কাছে হাসিনা এখনও “বিশেষ অতিথি”- কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, দিল্লির কৌশলও তত বদলাচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে ভারতকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত খুব সতর্কতার সঙ্গে নিতে হবে।

বাংলাদেশি জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক কূটনীতিক ওয়াহিদুজ্জামান নূর বলেন, জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের জন্য রায়টি এক গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের ক্ষতির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত। এই রায়ের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে যে, আন্দোলনের সময়কার হত্যাকাণ্ডের জন্য কেউ একজন দায়ী হবে।
তবে নূর উল্লেখ করেন যে, ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্নও উঠেছে। প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে আইসিটি আইন সম্প্রসারণ, দ্রুত বিচার, অনুপস্থিত অবস্থায় মামলা পরিচালনা, এবং হাসিনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত- এসব বিষয় নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব বিতর্ক সত্ত্বেও অনেকের কাছে রায়টি দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচারের দাবি পূরণের প্রতীক। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো।

নূর জানান যে, হাসিনা এখনও আওয়ামী লীগের মধ্যে গভীর আনুগত্য উপভোগ করেন এবং দলটি ভারত থেকেই তাকে নেতৃত্ব দিতে অনুমান করা হচ্ছে। ভারতের সতর্ক অবস্থান এবং মৃত্যুদণ্ডের উপস্থিতিতে তাকে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এরই মধ্যে দেশে প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে বিভক্ত; বিরোধী পক্ষ এটিকে বহু প্রতীক্ষিত হিসেবে দেখছে, আর আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মনে করছে এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ। রায় ঘোষণার আগের কয়েকদিন যেভাবে সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে, তা আগামী নির্বাচনের আগে আরও অস্থির পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ফিজি প্রজাতন্ত্রে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এম. ওসমান সিদ্দিক বর্তমান পরিস্থিতিকে জাতীয় সংহতি ও শান্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আহ্বান জানান। তার মতে, বাংলাদেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল এক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এ সময় প্রতিটি রাজনৈতিক পক্ষের সংযত আচরণ অপরিহার্য। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়া স্বচ্ছ থাকা এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখা অতীব প্রয়োজন, যেন নাগরিকদের আস্থা অটুট থাকে।

সিদ্দিক বলেন, দেশের শান্তি, নিরাপত্তা এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। রায় সম্পর্কে মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তার মতে, বাংলাদেশ এমন এক সময়ের মুখোমুখি যেখানে সংহতি ও দূরদর্শী নেতৃত্বই দেশের সঠিক পথ নির্ণয় করবে। mzamin.com




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD