সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:৩২ পূর্বাহ্ন




রাজধানীতে একক ব্যবস্থাপনায় বাস চালুর নির্দেশ

আউটলুক বাংলা রিপোর্ট
  • প্রকাশের সময়: রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৫:৩৪ pm
পরিবহন TRANSPORT STRIKE bus halt বাস ধর্মঘট
file pic

রাজধানীর যানজট নিরসন ও ঢাকা গণপরিবহন ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য সব বাস একক একটি ব্যবস্থার অধীনে চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু এই ‘একক ব্যবস্থাপনা’ কীভাবে হবে সেটা সুনিদির্ষ্টিভাবে বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। তবে বাস রুটের শৃঙ্খলা ফেরাতে গণপরিবহন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি পেশাদারিত্ব ইউনিট তৈরি করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি মোবাইল কোম্পানির মতো বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে পুরো দেশের বাস পরিচালনার পরামর্শ তাদের।

এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ‘বাস পরিচালনা একক ব্যবস্থা’ বলতে ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতির কথা বুঝাতে চেয়েছেন। তবে এটা হলে ভালো হবে। কিন্তু বাস কোম্পানির মালিকদের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু হলেই আন্দোলনে চলে যায় বাস মালিকরা। ঢাকার যা অবস্থা বিশে^র কোথাও এমনটা নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু করা উচিত। তা না হলে মানুষ বলবে ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে কিছুই করে যায়নি এই সরকার। কারণ, রাজনৈতিক সরকার দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না।

বাস কোম্পানির মালিকরা অনেকেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই কিছু করার এখনই সময়। তবে এই সরকারের হাতে যতটুকু সময় আছে, এর মধ্যে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করা উচিত। এর আগে গত ২৬ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকার বাস পরিবহন দীর্ঘদিন ধরে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলছে। এর ফলে যাত্রীরা প্রতিদিন জ্যাম, দুর্ঘটনা, ভাড়ায় প্রতারণা এবং নানা ভোগান্তির শিকার হন।

যেসব যাত্রী তরুণ এবং শারীরিকভাবে সক্ষম, তারা কোনোরকমে বাসে উঠতে পারেন, কিন্তু নারী, শিশু এবং বয়স্কদের জন্য এটি অনেক কঠিন হয়। ঢাকার যানজটের একটি বড় কারণ বিভিন্ন রুটে চলা অকার্যকর বাস। এ কারণে বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

প্রেস উইং জানায়, সব বাস একক একটি ব্যবস্থার অধীনে চলবে। কোম্পানিগুলোকে নির্ধারিত রুট ও স্টপেজ মেনে চলতে হবে। এর ফলে রুট শৃঙ্খলা ও ভালোভাবে পরিচালিত বাস সার্ভিসের মাধ্যমে সার্বিক যানজট, ভাড়ায় প্রতারণা এবং বিশৃঙ্খলা কমবে। যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে এবং গণপরিবহন হবে আরও কার্যকর। কিন্তু এই বাসের একক ব্যবস্থাপনা কিভাবে হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহসানুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নিদের্শনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। তবে কিভাবে কোন্ পদ্ধতিতে ‘একক বাস ব্যবস্থাপনা’ চালু করা হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। এটা নিয়ে বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।

এছাড়া বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সব মিলে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
২০ বছরেও হয়নি বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ॥ ২০০৪ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তৈরি করা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাÑ এসটিপিতে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, যাত্রীদের যানবাহন ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণ ও যানজটের কথা বিবেচনা করে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিক্ষিপ্তভাবে বাসের অনুমোদন না দিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়। কিন্তু গত ২০ বছরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এর প্রধান কারণ হিসেবে বাস্তবায়নকারী সংস্থায় উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব এবং সমন্বয়হীনতার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ছয়টি কোম্পানির অধীনে ঢাকার বাস সার্ভিস পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন পরিবহন মালিক, সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের রাজি করানো হয়। তিনি ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দলকে পরিকল্পিত বাস পরিচালনার বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করার দায়িত্ব দেন।

কিন্তু আনিসুল হকের মৃত্যুর পর সে উদ্যোগ অনেকটাই থেমে যায়। পরবর্তীতে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা’ পদ্ধতি প্রবর্তনের কার্যক্রম সমন্বয় করতে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি গঠন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এটি ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি’ নামেই পরিচিত।

এই কমিটির আহ্বায়ক হলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র বা প্রশাসক। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ডিটিসিএ, পুলিশ, রাজউক, বিআরটিএ, বিআরটিসি, সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এই কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। গত ছয় বছরে এই কমিটি ২৯টি সভা করেছে। গত বছর ১১ নভেম্বর ডিএসসিসির নগর ভবনে কমিটির সর্বশেষ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আর কোনো মিটিং হয়নি। এই কমিটির কার্যক্রম ও রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এখানেই উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব ও সমন্বয়হীনতার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, ‘ঢাকার মধ্যেই গুলশান এলাকায় ‘ঢাকা চাকা’ নামে পরিবহন চলে। ওই বাসগুলোতে কোনো আঁচড় নেই, চালকের মধ্যেও পাল্লাপাল্লির মনোভাব নেই। এর বাইরে পুরো ঢাকার দৃশ্য অন্য রকম। বাস কোম্পানিগুলোর পাল্লাপাল্লির কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, যানজট হয়, বিশৃঙ্খলা বাড়ে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি লাইনে অন্য কোনো বাস চলাচল করতে পারবে না। গুটি কয়েক কোম্পানির মাধ্যমে পুরো ঢাকা শহরের বাস সার্ভিস পরিচালনা করতে হবে। তা না হলে ঢাকাকে রক্ষা করা যাবে না।’ বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা: যাত্রীর তুলনায় ভালো বাসের সংখ্যা কম। প্রতিদিন ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হয় যাত্রীদের। নারী ও বয়স্ক যাত্রীদের অবস্থা খুবই খারাপ। ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে পারেন না তারা।
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী ‘গণপরিবহন’ অর্থ ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত বা ব্যবহার উপযোগী যে কোনো মোটরযানকে বুঝায়। সে হিসেবে ঢাকায় যেসব গণপরিবহন চলাচল করে সেগুলো হলো- বাস, মিনিবাস, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা। কিন্তু এর বাইরেও যাত্রী পরিবহনে ভাড়ায় চালিত ঢাকায় আরও অনেক মোটরযান চলাচল করে।

এর মধ্যে অ্যাপসের মাধ্যমে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা গণপরিবহনের সংজ্ঞার মধ্যে না পড়লেও ঢাকাসহ সারাদেশে এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে হারিয়ে গেছে ট্যাক্সিক্যাব। হলুদ ও কালো রঙের এই গণপরিবহনটি বর্তমানে ঢাকায় আর দেখা যায় না।

এছাড়া বাস, মিনিবাস ও লেগুনার অবস্থা ভয়াবহ। ভাঙা-নোংরা সিট ও লক্কড়ঝক্কড় বডি দিয়ে চলছে এই সব গণপরিবহন। যাত্রী সেবা তো দূরের কথা, প্রতিনিয়ত ভাড়া নিয়ে বাগ্বিত-া হয় যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকের সঙ্গে। সরকার নির্ধারিত ভাড়া মানে না কেউ। মিটারের কথা বললে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সিএনজি অটোরিক্সার চালক। মিটারের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া নেওয়া হয় সিএনজিতে। অথচ এই গণপরিবহনেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন যাত্রীরা। তবে সেবার মান খুবই খারাপ।

যারা গণপরিবহন ব্যবহার করেন, তারা ছাড়া এই কষ্ট কেউ বোঝে না। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগ বর্ণনাতীত। তবে যারা গণপরিবহন পরিচালনা বিষয়ে নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তারা গণপরিবহন ব্যবহার করেন না। তাই সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা কেউ চিন্তা করেন না বলে জানান যাত্রীরা।

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ইকবাল হোসেন নামের এক যাত্রী  বলেন, ‘শুধু গুলিস্তান নয়, পুরো ঢাকা শহরের গণপরিবহনের অবস্থা খুবই খারাপ। বাস, মিনিবাস ও লেগুনা সবার একই অবস্থা। লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনে নেই কোনো যাত্রী সেবা। ঢাকার বাসগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে ৩৮-৪৫ সিটের বাসে দাঁড়িয়ে নেওয়া হয় দ্বিগুণ যাত্রী। কিন্তু বাসের ভেতরে দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা নেই। গরমের মধ্যে বাসের ভেতরে যাত্রীদের গায়ের সঙ্গে ঘেষে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে হয়। এর মধ্যে আবার কন্ডাক্টর (চালকের সহযোগী) বাসের ভেতরেই ভাড়া আদায় করে। তখন আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হয়। ঢাকার মতো এই বাজে গণপরিবহন বিশে^র কোথাও নেই।’ ৬৪ শতাংশ মানুষ বাস ব্যবহার করে ॥ ঢাকা ও এর আশপাশের মানুষ দিনে দুই কোটির বেশিবার যাতায়াত (ট্রিপ) করেন। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ মানুষ বাস ব্যবহার করে বলে ঢাকার ২০ বছরের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এই গণপরিবহনেই যাত্রী সেবার মান খুবই খারাপ।

এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী বহন করে, আর ব্যক্তিগত যানবাহন যাত্রী বহন করে ১১ শতাংশ। অথচ ব্যক্তিগত যানবাহন ৭০ শতাংশ সড়ক দখল করে চলে। ৩০ শতাংশের কম জায়গায় চলে গণপরিবহন। এটি সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য।

তাই অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, অনুপযুক্ত সড়ক এবং মালিক শ্রেণির অপেশাদারি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ হতাহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের অধিকাংশই নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এবং পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষ।’ তাই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে বলে জানান তিনি। জনকণ্ঠ




আরো






© All rights reserved © outlookbangla

Developer Design Host BD