ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দল নিবন্ধনের কাজ গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কমিশনের স্বাক্ষর হওয়ার পর নতুন নিবন্ধিত দলগুলোর বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে নির্বাচন কমিশন। এর আগেই প্রাথমিক বাছাইয়ের পর টিকে থাকা ২২ দলের কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ে অস্তিত্ব, কমিটিসহ প্রাসঙ্গিক দলিলাদির সরেজমিন তদন্ত শেষ হয়েছে। এখন জানার অপেক্ষা- কারা পেতে যাচ্ছে ইসির নিবন্ধন সনদ।
ইসি ঘোষিত নির্বাচনী রোডম্যাপ অনুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন শেষ করার কথা ছিল। তবে কিছু দলের বিষয়ে আরও যাচাইয়ের সুবিধার্থে সময় লাগছে।
এমন তথ্য জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নতুন দল নিবন্ধনের কাজ দ্রুত চলছে। টার্গেট ছিল এ মাসে করে ফেলতে পারবো। বিভিন্ন দল নানা অভিযোগ নিয়ে আসছে। আমাদের কিছু অতিরিক্ত ইনফরমেশন কালেক্ট করতে হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তথ্য সংগ্রহ নয়, আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ চলছে। নিশ্চিত হতে হচ্ছে, তারা সঠিকভাবে দিয়েছে তথ্য। এজন্যে সময় লাগছে।’
তিনি আরও জানান, গণবিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞপ্তি দিলেও চূড়ান্ত নয়। কারও আপত্তি, অভিযোগ এলে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। এরপর চূড়ান্ত হবে। তবে কোন কোন দল নিবন্ধন পাচ্ছে- তা বলতে চাননি সিইসি।
৬ দল এগিয়ে
ইসি সূত্র বলছে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ ছয়টি দল নিবন্ধন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত সপ্তাহে বেশ কিছু দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির বাছাই কমিটি কথাও বলেছে। বুধবার এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাতে গেলে দলটি নিবন্ধন পাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেন ইসি কর্মকর্তারা।
ইসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২২টি দলের মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগসহ ছয়টি দলকে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন দিতে নথিতে ফাইল তোলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শাখার কার্যক্রম বা স্বাক্ষর হয়েছে গত ২১ সেপ্টেম্বর। ২২ সেপ্টেম্বর কমিশনের অনুমোদনের জন্য ফাইল কমিশনের কাছে পাঠানো হয়। তবে কমিশন চাইলে শাখার প্রস্তাবে সংযোজন-বিয়োজন করতে পারবে। মূলত কমিশনের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে।
ওই সূত্র আরও জানায়, মোট ছয়টি দলের নিবন্ধনের জন্য কমিশনের কাছে নথিতে ফাইল তোলা হয়েছে। ১০টি দলের বিষয়ে পুনতদন্ত করা হবে এবং বাকি ৬টি দলের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। এই ১০টি দলের মধ্যে ৯টির মাঠ পর্যায়ে পুনঃতদন্ত এবং একটি দলের পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে নির্বাচন কমিশনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে।
এর আগে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব আলী নেওয়াজ গত ১৪ এবং ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি দল ছাড়া ২০টি দলের শুনানি করেন। অন্যান্য বারের মতো এবারও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দল নিবন্ধনের আবেদন আহ্বান করে ইসি। এতে ১৪৩টি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছিল। প্রথম দফায় কোনো দলই শর্ত পূরণ না করায় সবাইকে সময় দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে বলেছিল ইসি। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ৮৪টি দল সাড়া দিলেও অন্যরা সাড়া দেয়নি। ৮৪টি দলের মধ্যে আবার ৬২টি দল ঘাটতি পূরণ করতে তথ্য জমা দিয়েও শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তাই, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ২২টি দলের মাঠ পর্যায়ে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শুনানি করে ইসি।
যে ২২টি দলের মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করা হয়
ফরোয়ার্ড পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), মৌলিক বাংলা, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি, জনতার দল, জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, ভাসানী জনশক্তি পাটি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাহজাহান সিরাজ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বাংলাদেশ সল্যুশন পার্টি ও নতুন বাংলাদেশ পার্টি।
আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে ইচ্ছুক দলের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি, এক তৃতীয় জেলা ও ১০০টি উপজেলা কমিটি এবং প্রতিটি কমিটিতে ২০০ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ থাকতে হয়। এছাড়া কোনো দলের কেউ আগে সংসদ সদস্য থাকলে বা আগের নির্বাচনের পাঁচ শতাংশ ভোট পেলেও নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে ধরে থাকে ইসি। এ প্রধান শর্তগুলো ছাড়াও বেশকিছু নিয়ম কানুন মেনে আবেদন করতে হয়।
নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দলগুলোর আবেদন পাওয়ার পর কমিশন প্রথমে এগুলো প্রাথমিক বাছাই করে। এরপর প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ দলগুলোর তথ্যাবলি সরেজমিন তদন্ত শেষে বাছাই সম্পন্ন করা হয়। পরবর্তীতে মনোনীত দলগুলোর বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে দাবি-আপত্তি চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেখানে কোনো আপত্তি এলে শুনানি করে তা নিষ্পত্তি করে কমিশন। আর কোনো আপত্তি না থাকলে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করে সংস্থাটি। নিবন্ধন ছাড়া কোনো দল নিজ প্রতীকে ভোটে প্রার্থী দিতে পারে না।
বর্তমানে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫১টি (আওয়ামী লীগসহ)। এবার আরও ছয়টি দল নিবন্ধন পেলে ইসির নিবন্ধিত মোট দলের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৭টি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রথা চালু করে ইসি।
গোল বেধেছে শাপলা নিয়ে
দলটির নিবন্ধন পাওয়ার বিষয়ে বরাবরই আশাবাদী বলে জানিয়ে আসছেন এনসিপি নেতারা। তবে দলীয় প্রতীক শাপলা দলটিকে দেওয়া হবে না বলে জানানো হয় ইসির তরফ থেকে।
এনসিপি শাপলার পাশাপাশি সাদা ও লাল শাপলা প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে দুইবার। কিন্তু ১১৫টি প্রতীককে তালিকায় রেখে বুধবার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ইসি, সেখানে শাপলাকে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে রাখেনি তারা। এ বিষয়ে বুধবারই ইসি বরাবর দেওয়া আরেক আবেদনে শাপলাকে প্রতীক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি দলটিকে শাপলা প্রতীক বরাদ্দ না দিলে তা কীভাবে আদায় করতে হয় জানা আছে- এমন মন্তব্য করেছেন এনসিপি নেতারা।
তবে বৃহস্পতিবার সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া হবে না। প্রতীকটি প্রথমে চেয়েছিল নাগরিক ঐক্য। তাদের দেওয়া হয়নি। পরে এনসিপি চেয়েছে, কাউকেই দেওয়া হবে না। আর শাপলা প্রতীক কেন দেওয়া হবে না, তার ব্যাখ্যাও দেবে না নির্বাচন কমিশন।
সিইসির এমন বক্তব্যের জবাবে আবারও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এনসিপি নেতারা। শাপলা প্রতীক নিয়ে সিইসির বক্তব্যের জবাবে বৃহস্পতিবারই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি লিখেছেন, ‘কারণ উপরের অনুমতি নেই। উত্তর দিক থেকে সিগন্যাল নেই।’ যদিও নিজের পোস্টে ‘উপরের অনুমতি’ এবং ‘উত্তরের সিগন্যাল’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট করেননি।
এছাড়া মৌলভীবাজারে দলীয় এক অনুষ্ঠানে দলটির আরেক মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেছেন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আইনি বাধা না থাকলেও অন্য কোনো চাপের কারণে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিচ্ছে না। এটি কমিশনের ব্যর্থতা।